published : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
যত্নায়ন। কোয়ান্টাম পরিভাষায় এ শব্দটির অর্থ হলো, দেহ-মনের সুস্থতা ও প্রশান্তির জন্যে যথাযথ মনোযোগ ও বিজ্ঞানসম্মত যত্ন। আমাদের সার্বিক সুস্বাস্থ্যের জন্যে এটি হতে পারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর একটি অনুশীলন। দৈনন্দিন জীবনযাপনে নানা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সচেতন-অসচেতনভাবে আমাদের দেহ-অভ্যন্তরে এবং মনের গভীরে নানা রকম স্ট্রেস ও টক্সিন বা বিষাণুর সৃষ্টি হয়, যা আমরা বের করে দিতে পারি এই যত্নায়নের মাধ্যমে। যত কার্যকরভাবে এটা আমরা করতে পারব ততই বাড়বে আমাদের সুস্থতার শক্তি ও প্রশান্তির স্থায়িত্ব।
যত্নায়নের প্রথম ধাপটি হচ্ছে দম। সঠিকভাবে দম নেয়া ও ছাড়ার মাধ্যমে আমরা দেহকে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডমুক্ত করতে পারি। তাই দম যত সঠিক হবে তত আমাদের এনার্জি লেভেল বাড়তে থাকবে। সারাদিন পরিশ্রম করেও দেহ থাকবে ক্লান্তিহীন ও কর্মক্ষম। এজন্যে দিনে অন্তত পাঁচ বার উজ্জীবন বা বিশেষ নিয়মে বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস করুন। দিন কয়েকের মধ্যে একটা চনমনে পরিবর্তন নিজেই অনুভব করবেন।
যত্নায়নের দ্বিতীয় ধাপে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। কারণ খাবারের মধ্য দিয়ে যাতে দেহে টক্সিন প্রবেশ না করে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাই সবসময় রাসায়নিকমুক্ত প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার এবং মৌসুমি ফলমূল খেতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হবে একটাই-স্বাস্থ্যের জন্যে যা ভালো সেটাই খাব। আর টক্সিনযুক্ত খাবার ও পানীয়, যেমন : সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার, অতিরিক্ত তৈলাক্ত-ভাজাপোড়া ও অধিক চিনিযুক্ত খাবার, এলকোহল, কোমল পানীয়, এনার্জি ড্রিংকস, ধূমপান অবশ্যই বর্জন করতে হবে।
এটি যত্নায়নের তৃতীয় ধাপ। আর সব ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে সহজ, আধুনিক ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন ব্যায়াম হচ্ছে কোয়ান্টাম ব্যায়াম। যা আমাদের শরীরের হরমোনাল, বায়ো-ইলেক্ট্রিক্যাল ও নার্ভাস সিস্টেমসহ দেহের সবগুলো সিস্টেমের মধ্যে আন্তঃপারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রাখে দারুণভাবে। এর পাশাপাশি প্রতিদিন (সপ্তাহে ন্যূনতম পাঁচ দিন) ২০ থেকে ২৫ মিনিট হাঁটা সুস্থতার জন্যে অত্যন্ত সহায়ক। সুস্বাস্থ্যের জন্যে হাঁটা ও ব্যায়ামের বহু রকম উপকার তো আছেই, এ-ছাড়াও এতে ঘামরূপে ত্বকের মধ্য দিয়ে অনেক ক্ষতিকর টক্সিন দূরীভূত হয়ে যায়।
যত্নায়নের চতুর্থ ধাপে রয়েছে হজম। প্রথমত, এর জন্যে আমাদের খাবারটাই এমন সুপাচ্য হওয়া উচিত যেন সহজে হজম হয়। দ্বিতীয়ত, খাবার গ্রহণের পরিমাণ। এ ব্যাপারে নবীজী (স)-এর শিক্ষা হচ্ছে, খাওয়ার সময় পাকস্থলীর এক তৃতীয়াংশ শক্ত খাবার, এক তৃতীয়াংশ তরল এবং এক তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখো। অর্থাৎ একটু ক্ষুধাভাব থাকতেই খাওয়া শেষ করা। পরিপাকতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গেছে, এমন খাদ্যাভ্যাসে হজম ভালো হয়।
রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্রাব-পায়খানার সাথে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন নির্গত হয়। সুস্থতার জন্যে এসব বর্জ্য পদার্থ প্রতিদিন বেরিয়ে যাওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে দেহের সার্বিক পরিচ্ছন্নতাও সুন্দরভাবে বজায় থাকে। সহজপাচ্য খাবার, ব্যায়াম ও হাঁটা সুরেচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
এসবের পাশাপাশি সুস্থতার জন্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত গোসল করার মধ্য দিয়েও শরীর থেকে বহু ধরনের টক্সিন বেরিয়ে যায়। রসুলুল্লাহ (স)-এর শিক্ষারও একটা বড় অংশ হচ্ছে পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে তিনি ঈমানের অর্ধেক হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আমরা আসলে অধিকাংশ সময়ই সুস্থ থাকি। অসুস্থ হই কখনো কখনো। আমাদের ৭৫ ভাগ রোগের কারণ হলো শরীরের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া টক্সিন-যার উৎস হতে পারে নেতিচিন্তা, অস্বাস্থ্যকর খাবার, অসুস্থ বিনোদন, মাত্রাতিরিক্ত আবেগীয় সম্পর্ক ও শখ, ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি ইত্যাদি। বাকি ২৫ ভাগ রোগের কারণ হতে পারে ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসজনিত, যথাযথ পুষ্টির অভাব ও ভুল ওষুধ বা সার্জারির জটিলতা।
সাধারণত দুভাবে আমরা এ বিষাণুতে আক্রান্ত হতে পারি। প্রথমত, মন অসুস্থ হলে টক্সিন তৈরি হতে পারে। যেমন : দুশ্চিন্তা রাগ ক্ষোভ ঘৃণা ঈর্ষা গীবত থেকে টক্সিন সৃষ্টি হতে পারে। আবার বস্তুগত কোনো অস্তিত্ব নেই এমন কিছু অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গিগত ভুল থেকেও টক্সিন সৃষ্টি হতে পারে।
তথাকথিত বিনোদনের ফলেও দেহ-মনে স্ট্রেস ও টক্সিন সৃষ্টি হতে পারে। যেমন : টিভিতে অধিকাংশ সময়ই আমরা দেখছি ভায়োলেন্স হিংসা সন্ত্রাস মারামারি চক্রান্ত ষড়যন্ত্র পরকীয়া। টিভিতে দেখা এসব ঘটনা এবং চরিত্র আমাদেরকে নেতিবাচকভাবে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। বাস্তব জীবনেও অবচেতনভাবে প্রলুব্ধ করে এসব ঘটনায় জড়িয়ে পড়তে। ফলে আমাদের ভেতরে সৃষ্টি হয় টেনশন হতাশা আসক্তি আর অন্তর্দ্বন্দ্ব। এসব থেকেও দেহের ভেতরে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ টক্সিন।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন কারণেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে আমাদের শরীরে টক্সিন প্রবেশ করতে পারে নানাভাবে। যেমন : আমরা এখন প্রতিনিয়ত টিভি, মোবাইল ও স্মার্টফোনসহ ঘরে-বাইরে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের রেডিয়েশনের সম্মুখীন হচ্ছি। মোবাইল টাওয়ার থেকে প্রতিনিয়ত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ক্ষতিকর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রশ্মি। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্টর্ম, যা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর এমনকি প্রাণঘাতীও হতে পারে।
আর আধুনিককালে টক্সিন সৃষ্টি হওয়ার একটা বড় মাধ্যম হলো মোবাইল ফোন বিশেষত স্মার্টফোন। মোবাইল-নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় একাগ্রভাবে বসে কোনো কাজ করা এখন আর সম্ভব হয় না। সময়ে-অসময়ে বার বার ফোনকল আসায় অনিচ্ছায় হলেও আমরা সেটা রিসিভ করি, কিন্তু বিরক্তি নিয়ে। এই বিরক্তির উদ্রেক হওয়াতেও আমাদের ভেতরে টক্সিন সৃষ্টি হচ্ছে।
আমরা লক্ষ করলে দেখব, দেহে টক্সিন বেশি হলে এসিডিটি বেড়ে যায়। এসিডিক অবস্থার বিপরীত হচ্ছে এলকালাইন অবস্থা। এলকালাইন হচ্ছে দেহের এমন এক অবস্থা যখন আমরা প্রশান্ত থাকি, সুস্থ থাকি। আর দেহকে সবসময় এই এলকালাইন অবস্থায় রাখার জন্যেই প্রয়োজন মেডিটেশন। এলকালাইন বা প্রশান্ত অবস্থা একজন মানুষকে স্ট্রেস ও টক্সিনসৃষ্ট ৭৫ ভাগ রোগ থেকে মুক্ত রাখতে পারে।
সুস্থ থাকার জন্যে সঠিক যত্নায়নের সাথে সাথে নিরাময়ের আরো চারটি শাশ্বত উপায় হলো ধ্যান, দোয়া, দান এবং দাওয়া। মন স্থির না হলে, মনে প্রশান্তি না এলে দেহে প্রশান্তি আসবে না। কখনো সুস্থতা আসবে না। ধ্যান বা মেডিটেশন আমাদের অন্তরে এই প্রশান্তি নিয়ে আসে। আর ধ্যানের পাশাপাশি নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে প্রয়োজন দোয়া বা হিলিং। কারণ আন্তরিক প্রার্থনা নিরাময় প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করে।
রোগ নিরাময়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে সদকা বা দান। যারা নিয়মিত দান করেন তাদের জীবনে বিপদ যদি আসে তুফানের মতো তবে চলে যায় বুদ্বুদের মতো। সৎ দানের বিনিময়ে স্রষ্টা মানুষকে অনেক বিপদ ও বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। চিকিৎসায় যে পরিমাণ অর্থ খরচ হতে পারে অসুস্থ হওয়ার আগে অর্থাৎ সুস্থ থাকতেই সে অনুপাতে আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ দান করা যেতে পারে।
৭৫ ভাগ রোগ নিরাময়ের জন্যে ধ্যান, দোয়া ও দান-এই তিনটিই যথেষ্ট। বাকি ২৫ ভাগের জন্যে প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা বা দাওয়া। নিরাময়ের জন্যে ওষুধের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দাওয়া বা পথ্য।
শারীরিক মানসিক সামাজিক এবং আত্মিক-জীবনের এই প্রতিটি দিকেই ভালো থাকার নাম হচ্ছে সুস্থতা। সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে বিশেষ জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন হয় না, বরং প্রয়োজন জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির। আর এজন্যে স্রষ্টা আমাদেরকে যে স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়েছেন এটি প্রয়োগ করাই যথেষ্ট। তাই আমরা বলতে পারি, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিপূর্ণ যত্নায়ন দেহ-মনকে স্ট্রেস ও টক্সিনমুক্ত করে। রাখে সুস্থ ও কর্মচঞ্চল।