মেডিটেশন করুন ॥ বাড়বে আপনার নিরাময় ক্ষমতা

published : ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

বিজ্ঞানের জগতে একের পর এক ঘটে চলেছে অভাবনীয় সব অগ্রগতি। এই ধারাবাহিকতায় গত কয়েক দশকে ঘটেছে নিউরোসায়েন্সের অভূতপূর্ব বিকাশ। দুর্জ্ঞেয় মস্তিষ্কের শক্তিরহস্য একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে আমাদের সামনে। ক্রমান্বয়ে বোঝা সম্ভব হচ্ছে মস্তিষ্কের বিচিত্র গঠন আর গতি-প্রকৃতি। মস্তিষ্ক নিয়ে বিজ্ঞানীদের অহর্নিশ গবেষণা তাই চলছেই।

সাম্প্রতিক এমনই কিছু গবেষণার ফলাফল থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, মস্তিষ্কের ক্ষমতার সাথে মনের শক্তির সংযোগ ঘটিয়ে নিরাময়ের জগতে সূচিত হতে পারে এক অফুরন্ত সম্ভাবনা।

মস্তিষ্কের জিন ম্যাপিং ॥ সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত

মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা পল অ্যালেন। গত দশকের শুরুর দিকে ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘অ্যালেন ইনস্টিটিউট ফর ব্রেন সায়েন্স’। বিশ্বের প্রথমসারির কজন নিউরোসায়েন্টিস্টকে এখানে জড়ো করেন তিনি। শুরু হয় গবেষণা।

এ উদ্যোগের ফলেই ২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয় অ্যালেন ব্রেন এটলাস ও ব্রেনের জিন ম্যাপিং। এ প্রকল্পটিতে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেন ৬০ জন গবেষক। বিশেষ প্রযুক্তি ও সফটওয়্যারের সাহায্যে তারা মানব মস্তিষ্কে ২১,০০০ জিনের সন্ধান পান, যাদের প্রত্যেকটিই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মস্তিষ্ক কোষ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা রকমের কাজ।

অ্যারিজোনার ট্রান্সলেশনাল জিনোমিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. ডাইট্রিচ স্টিফেনের মতে, মস্তিষ্কের জিন ম্যাপ উদ্ঘাটন বিজ্ঞানের জগতে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।

মস্তিষ্ক-জটিলতা থেকে মিলবে মুক্তি

৭১ বছর বয়সী অ্যানা হিকারসন। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায়। বছর কয়েক আগে কিছু সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন তিনি। দিন-তারিখ ভুলে যাচ্ছিলেন, স্বামী জেম্স হিকারসনের সাথে প্রতিদিন ফ্লাওয়ার-শপে যেতেন যে পথে, সেই রাস্তাটিও তিনি প্রায়ই ভুলে যাচ্ছিলেন। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে, তিনি একসময় ড্রাইভিংও ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। একপর্যায়ে তারা স্বামী-স্ত্রী মিলে দেখা করেন ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব মেডিসিনের নিউরোলজিস্ট প্রফেসর র‌্যাল্ফ রিচার-এর সাথে। জানা গেল,অ্যানা হিকারসন আলঝেইমার্স রোগে ভুগছেন।

বয়সজনিত স্মৃতিভ্রম রোগ আলঝেইমার্স। এ রোগে বিটা-এমাইলয়েড নামক একটি রাসায়নিক উপাদান পর্যায়ক্রমে মস্তিষ্কের কোষগুলোর মৃত্যু ঘটায়। রোগীরা ওষুধ সেবন করে ঠিকই, কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় না।

মস্তিষ্কের জিন ম্যাপিং-এর সূত্র ধরে তাই বিজ্ঞানীরা আলঝেইমার্স-এর একটি নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ওষুধটি টানা দুবছর অ্যানা-র ওপর প্রয়োগ করা হয়। দেখা গেছে, অ্যানা-র অবস্থার যে ক্রম-অবনতি ঘটছিলো তা তো রোধ হয়েছেই, সেইসাথে তিনি এতদিন যেসব কথা ভুলে যাচ্ছিলেন তা-ও প্রায় আগের মতোই মনে করতে পারছেন। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি তিনি নিজেই ড্রাইভ করেছেন ৩৭ মাইলেরও বেশি পথ। অ্যানার ভাষায়, এখন আমি আগের চেয়ে অনেক ঝরঝরে আর ভালো বোধ করছি। অ্যানার স্বামী জেম্সের মতে, এটা সত্যিই একটা আশীর্বাদ।

এই ধারাবাহিকতায় বিজ্ঞানীরা এখন মনে করছেন, সেদিন খুব বেশি দূরে নয় যেদিন সব ধরনের মস্তিষ্ক-জটিলতার সমাধান করা সম্ভব হবে। এছাড়াও শরীরের যেকোনো অঙ্গের অসুস্থতায় প্রয়োজনে শুধু সে নির্দিষ্ট অঙ্গের ওপর ওষুধ প্রয়োগ করা যায়, কিন্তু মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে সরাসরি বা রক্তের মাধ্যমে কোনো ওষুধ মস্তিষ্কে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। নিউরোসায়েন্টিস্টরা এখন আশাবাদী হয়ে উঠেছেন যে, মস্তিষ্কের যেকোনো সমস্যায় সরাসরি ওষুধ প্রয়োগের প্রযুক্তিটিও এখন সহজ হয়ে উঠবে।

রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা হবে সংহত

মস্তিষ্ক নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় প্রতিনিয়ত আবিষ্কৃত হচ্ছে এর অভাবনীয় সব ক্ষমতা। এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো, মস্তিষ্ক আমাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সংহত ও উজ্জীবিত করে তোলার মাধ্যমে যাবতীয় রোগব্যাধি-জীবাণুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে দুই দশক দীর্ঘ গবেষণা করেছেন নিউইয়র্কের ফেইনস্টেইন ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল রিসার্চের পরিচালক নিউরোসার্জন ও ইমিউনোলজিস্ট ড. কেভিন ট্রেসি। তার মতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে উদ্দীপ্ত করে তোলার মাধ্যমে রিউমেটয়েড আর্থ্রারাইটিস ও হৃদরোগসহ দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর চিকিৎসায় ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হবে।

নিরাময়, এমনকি ক্যান্সার ঠেকাতে চাই ধ্যানমগ্ন প্রশান্তি

মেডিটেশন এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, বলেন ড. ট্রেসি। তার মতে, মেডিটেশন শরীরের সব স্নায়ুকোষগুলোকে শান্ত সুস্থির অবস্থায় নিয়ে আসে। আমাদের হৃৎস্পন্দনের গতি হয়ে ওঠে স্বাভাবিক। মস্তিষ্ক তখন রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চমৎকারভাবে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে রোগব্যাধি, সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে একটি কার্যকর প্রতিরোধ। এ নিয়ে ড. কেভিন ট্রেসির উচ্ছ্বসিত মন্তব্য-‘এ পর্যন্ত যত ধরনের বিষয় নিয়ে আমি কাজ করেছি তার মধ্যে সত্যিই এটা সবচেয়ে দারুণ।’

গবেষণাটিতে দেখা গেছে, নিয়মিত মেডিটেশনের ফলে শরীর-মনে যে প্রশান্তি আসে, তাতে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের ভাইরোলজিস্ট ড.রোনাল্ড গ্ল্যাসার। ল্যাবরেটরি টেস্টে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্ট্রেস হরমোন নর-এপিনেফ্রিন ক্যান্সার সেলকে উদ্দীপিত করার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সার ছড়িয়ে দেয়। তার মতে, তাই ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হতে চাই স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ। আর স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

নিরাময়ের আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি : মনছবি

মানব মন আর মস্তিষ্কের বিস্ময়কর নিরাময়শক্তি বিজ্ঞানীদের আরো নিত্যনূতন গবেষণায় উৎসাহী করে তুলছে। আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ আরো দুটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা এমনই একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। ক্রনিক ব্যথায় ভুগছেন এমন কয়েকজন রোগীকে বিশেষ কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে তাদের নিজ নিজ মস্তিষ্কের ছবি দেখানো হয় ও এর কর্মপ্রক্রিয়া সম্বন্ধে একটি ধারণা দেয়া হয়। তারপর তাদের বলা হয়, মস্তিষ্ক তার নিজস্ব নিরাময় প্রক্রিয়ায় ব্যথা নিরাময় করছে-এ দৃশ্যটি কল্পনা করতে।

এ গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী ড. সিয়েন ম্যাকি বলেন,‘পরবর্তীতে দেখা গেছে, এদের অনেকেরই ব্যথার তীব্রতা শতকরা ৪০ ভাগ পর্যন্ত কমে গেছে।’ তার ভাষায়, ভবিষ্যতে এমন দিন আসছে যখন একজন চিকিৎসক তার রোগীদের কল্পনাশক্তি শাণিত করার পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেবেন-যাতে বিষণ্নতা, বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর আসক্তি ও ভয় থেকে তারা নিজেরাই মুক্ত হতে পারে। তখন হয়তো ফিটনেস সেন্টারের বদলে গড়ে উঠবে ব্রেন-ইমেজিং সেন্টার, যেখানে গিয়ে একজন মানুষ নিজের কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে তার দরকার মতো মস্তিষ্কের যেকোনো অংশকে আরো কার্যকর করে তুলতে পারবে। আর এভাবেই সে হয়ে উঠবে অধিকতর দক্ষ, চৌকস, উন্নত স্মৃতিশক্তি ও উচ্চতর বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একজন মানুষ।

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকে মস্তিষ্ক-গবেষণায় এমন বিস্ময়কর সব ফলাফল আমূল বদলে দিচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের পুরনো সব ধ্যানধারণা। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের ইন্টিগ্রেটিভ নিউরাল ইমিউন প্রোগ্রামের পরিচালক ড.এস্থার স্টার্নবার্গ বলেন, বিজ্ঞান ও আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় মনোদৈহিক নিরাময়ের যে দৃষ্টিভঙ্গিটি এতদিন উপেক্ষিত ছিলো, সব কৃতিত্ব বুঝি এবার তাকেই দিতে হবে।

তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট (মে ২০০৭)