সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য জীবনকে সুখী করে- সুস্থ রাখে শরীর মন

“জীবনে যার বেঁচে থাকার একটা ‘কারণ’ আছে, জীবনটা তার জন্যে অনেক সহজ।” উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নীটশের কথা এটি। এরপর দু-শতাব্দী পেরিয়ে গেছে, কিন্তু হালের মনোবিদ ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের বহু গবেষণালব্ধ ভাষ্য আজও ঠিক সেটাই, তা হলো, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য মানুষকে সুখী ও দীর্ঘায়ু করে। শরীর-মনকে রাখে সুস্থ ও প্রাণবন্ত। বাড়িয়ে তোলে তার কর্মক্ষমতা।

চলুন খুঁজে দেখা যাক কী তার রহস্য।

লক্ষ্যই জীবনের মূল চালিকাশক্তি

জীবনের এক ধ্রুবসত্য এ বাক্যটি। জীবন গতিময় হয়ে ওঠে লক্ষ্যকে অনুসরণ করেই। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য জীবনে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়। সুদীর্ঘ গবেষণার ফলাফলে বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, যারা বেঁচে থাকেন একটা লক্ষ্যকে ঘিরে, তারা লাভ করেন দীর্ঘজীবন। ঘুম ভালো হয় তাদের। স্ট্রোক ও বিষণ্নতার ঝুঁকি থেকে তারা মুক্ত থাকেন। অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় সূচকেও তাদের অবস্থান অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক ভালো।

গবেষকদের মতে, লক্ষ্যাভিসারী মানুষেরা যে-কোনো আসক্তি কাটিয়ে উঠতে পারেন দ্রুত। আছে আরো আরো বিস্ময়কর তথ্য-রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে তারা অগ্রণী। চিকিৎসকরা বলছেন, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো যদি এ দাওয়াইটা কোনোভাবে বোতলজাত করতে পারত তবে ওদের বিলিয়নিয়ার হওয়া আর ঠেকাত কে!

লক্ষ্য কীভাবে জীবনের গতিধারাকে প্রভাবিত করে, দেহ-মনে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করে-এ নিয়ে প্রথম গবেষণা শুরু করেন অস্ট্রিয়ান মনোবিদ ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইহুদি নিধনযজ্ঞ থেকে বেঁচে ফেরা একজন কিংবদন্তী স্নায়ু-চিকিৎসক তিনি।

নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দি দিনগুলোতে ভিক্টর অন্যান্য সহবন্দিদের পর্যবেক্ষণ করতেন। তখন তিনি দেখেছেন, অবিরাম নির্যাতন আর দুর্ভোগে যারা বোধশক্তি হারিয়ে বসেছিল, সামনে কোনো আশা দেখতে পাচ্ছিল না, খুঁজে পাচ্ছিল না বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য, তারা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে পড়ছিল এবং একসময় জীবন থেকে পুরোপুরিই হারিয়ে গিয়েছিল ওরা। পরবর্তীতে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কল এসব বিষয় নিয়েও বিস্তারিত লিখেছেন এবং বিশ্বযুদ্ধের পর নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ‘জীবনে লক্ষ্যের প্রভাব’ সংক্রান্ত গবেষণায়।

লক্ষ্য মানুষকে বদলে দেয়- কমায় রোগঝুঁকি, রাখে সুস্থ

গবেষকরা এখন লক্ষ্যকে দেখছেন জীবন বদলের অনুঘটক হিসেবে। তারা বলছেন, লক্ষ্য হতাশা দূর করে। জীবনে আনে সন্তুষ্টি। মানুষকে বদলে দেয় ভেতর থেকে। তার দৈনন্দিন আচরণ-অভ্যাসে সূচিত হয় দৃশ্যমান পরিবর্তন। সবমিলিয়ে বলা যায়, জীবনে সুখী হওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষ্যের রয়েছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।

বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে স্বাস্থ্যের ওপর লক্ষ্যের ইতিবাচক প্রভাব সবিশেষ লক্ষণীয়। ১০ বছরের ধারাবাহিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, লক্ষ্য-সচেতন মানুষেরা নিয়মিত ব্যায়াম ও সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি সঠিক জীবনাচার অনুসরণে এবং মাদকাসক্তির মতো বদভ্যাস বর্জনে অনেকাংশে আন্তরিক। এর পাশাপাশি ঘুম-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে এবং জীবনের অন্যান্য স্বাভাবিক আনন্দ উদযাপনে এরা অধিকতর সক্ষম।

১৬ হাজার মধ্যবয়সী মার্কিন ও ব্রিটিশ নাগরিকের ওপর পরিচালিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এদের মধ্যে যারা নিজ লক্ষ্যের ব্যাপারে যত সচেতন ছিলেন- রোগ ও অন্যান্য কারণে তাদের মৃত্যুহার তত কমেছে। হৃদরোগের ঝুঁকি কমেছে ২৭ শতাংশ, স্ট্রোকের ২২ শতাংশ, বয়সজনিত স্মৃতিভ্রম আলঝেইমার্সের ঝুঁকি নেমে এসেছে অর্ধেকে।

লক্ষ্য আক্ষরিক অর্থেই ধন্বন্তরি। একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত এটি। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক প্যাট্রিক হিলের মতে, লক্ষ্য-সচেতন মানুষের জীবনে আয় ও প্রাচুর্যের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি।

লক্ষ্য-সচেতনতা জীবনকে অর্থবহ করে- নার্ভাস সিস্টেমকে করে সংহত

লক্ষ্য মানুষকে কর্মোদ্যমী করে। তাকে উজ্জীবিত করে কর্তব্যবোধে। জীবনকে করে তোলে অর্থবহ। এ নিয়ে আশ্চর্য তথ্য দিচ্ছেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক শিগেহিরো ওশি। ১৩২টি দেশের এক লক্ষ ৪১ হাজার নাগরিকের ওপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে তিনি বলছেন, ধনী দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকেরা এদিক থেকে এগিয়ে আছেন। ধনী দেশগুলোতে বহুরকম সম্ভাব্য সুযোগের সামনে একজন মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধান্বিত হন, তুলনায় দরিদ্র দেশের মানুষের কাছে সেটি অধিকতর স্পষ্ট। ফলে এরা সহজেই বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পান।

আর লক্ষ্যহীন জীবনে বাঁচার কোনো অর্থ খুঁজে না পেয়ে হা-হুতাশে যারা অস্থির, তাদের জন্যে দুঃসংবাদ। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিভেন কোল বলেন, একাকিত্ব ও এর ফলে সৃষ্ট স্ট্রেস মানবদেহের জিনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা দেহে রোগ-প্রতিরোধী অ্যান্টিবডির কাজকে ব্যাহত করে, বাড়ায় হৃদরোগ, আলঝেইমার্স ও ক্যান্সারের ঝুঁকি।

লক্ষ্য-সচেতনতা দেহের নার্ভাস সিস্টেমকে সংহত করে। ফলে উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতি ও বিপদে দেহে এড্রিনালিন নিঃসরণের পরিমাণ কমে এবং হার্ট রেট ও শ্বাসপ্রশ্বাস থাকে নিয়ন্ত্রণে। কমে স্ট্রেসজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।