ওমর খৈয়াম : সাহিত্যিক, দার্শনিক, জ্যোতির্বিদ আর নিখাদ আল্লাহপ্রেমী যে মানুষটিকে পাশ্চাত্য বানিয়েছে মদারু!

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন সুফি সাধক ওমর খৈয়াম। পারস্যের কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ হিসেবেই বেশি পরিচিত যিনি।

বীজগণিতের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ‘ট্রিটাইস অন ডেমনস্ট্রেশন অব প্রব্লেমস অব অ্যালজেব্রা’তে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের একটি পদ্ধতি বর্ণনা করেন। 

ধারণা করা হয়, রেনে দেকার্তের আগে তিনি বিশ্লেষণী জ্যামিতি আবিষ্কার করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গণিতের দ্বিপদী উপপাদ্যও আবিষ্কার করেন।

কাব্যপ্রতিভার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে জ্যোতির্বিদ চরিত্র 

তিনি যে কত বড় মাপের জ্যোতির্বিদ ছিলেন তা বোঝা যায় একটি ঘটনা থেকে।

৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রবর্তিত ঐতিহ্যবাহী ক্যালেন্ডার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। এরপরে এলো গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডার।এই ক্যালেন্ডারে ৩০০০ বছরে এক দিনের ব্যবধান হবে। অর্থাৎ, একটা নতুন দিন যোগ করতে হবে সময় ঠিক করার জন্যে। 

ওমর খৈয়াম মাত্র ২৫ বছর বয়সে একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করেন, যা তারিখ-ই-জালালি নামে পরিচিত।এতে ১ দিন যোগ করতে হয় ৫০০০ বছরে একবার! এতটাই সূক্ষ্ম ছিল তার হিসাব।

ছিলেন একজন অসাধারণ সেবক

একবার কান্দাহার এবং তার আশপাশের এলাকাগুলোতে মহামারি আকারে গুটিবসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, উজাড় হয়ে যায় গ্রামকে গ্রাম। রাস্তাঘাট, বাড়ির উঠান, মসজিদের পাশ সব জায়গাতেই লাশের ঢিবি। যে এলাকায় কবর দেয়ার কেউ ছিল না সেখানে ঘরে ঘরে ছড়াতে লাগল লাশের দুর্গন্ধ। 

সে-সময় খৈয়ামের পীর সকল শীষ্যকে সাধন-মাগন ত্যাগ করে অসুস্থের সেবায় কাজ করার নির্দেশ দিলেন। খৈয়াম ও তার সঙ্গীরা নেমে গেলেন কাজে। কারো জন্যে দাওয়া, কারো জন্যে দোয়া, কারো দাফন-কাফন করাই ছিল দিনরাতের কাজ।

একদিন এক নির্জন বাড়িতে এক রোগিণীর কাতরানোর শব্দ শুনে তারা ভেতরে গিয়ে দেখেন আক্রান্তের পাশে তিনটি লাশ পড়ে আছে। রোগিণীর দেহে কাঁঠাল কাঁটার মতো গুটি বসন্ত বেরিয়েছে। সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছেন না জিহ্বা আর মুখে ঘা হওয়ায়। 

তাকে নিয়ে খৈয়ামসহ চারজন রওনা হলো চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই দুর্গন্ধ ও দেহের তাপ সহ্য করতে না পেরে খৈয়ামের কাঁধে সব ভার দিয়ে তিনজন সঙ্গীই প্রস্থান করলেন। খৈয়াম একাই কাঁধে করে তাকে নিয়ে গেলেন চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে।

স্রষ্টাপ্রেমিক মানুষ ছিলেন তিনি 

মৃত্যুর দিন ইবনে সিনার কিতাবুশ শেফা বইটি পড়ছিলেন। পড়তে পড়তে তার খেয়াল হলো যে, সময় হয়ে এসেছে। ওজু করে যোহরের নামাজ পড়লেন এবং খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মৌন থাকলেন। 

আসরের ওয়াক্ত হলো; খৈয়াম সেজদায় গেলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! এই সময়ের জন্যেই আমি অপেক্ষা করছিলাম! আজকে যেন তোমার ক্ষমা এবং করুণা থেকে বঞ্চিত না হই। 

এই সেজদাই ছিল স্রষ্টার সাথে তার মিলনের শেষ ধাপ। তার মৃত্যুটা ছিল সমর্পিতের মৃত্যু। 

অথচ পাশ্চাত্য তাকে চিত্রিত করেছে মদারুরূপে!   

ওমর খৈয়াম সাহিত্যিক হিসেবে সুবিদিত রুবাইয়ের কারণে। খুব কম শব্দ খরচ করে বেশি কথার স্থান সংকুলানই হলো রুবাই। দার্শনিকরা আস্ত একটি বই লিখেও যে ভাব পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন নি, গভীর অর্থবহ চার-লাইনের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ওমর খৈয়াম তা সহজেই তুলে ধরতেন।

তৎকালীন সমাজে ফার্সি সুফি কবিরা রূপক অর্থে তুলে ধরতেন স্রষ্টাপ্রেমকে। ওমর খৈয়ামও সেভাবেই লিখেছেন। কিন্তু গোল বেঁধেছে রুবাই অনুবাদ করার সময় রূপককে ভাবার্থে না নিয়ে আক্ষরিক অর্থ করায়।

রুবাই অনুবাদ করে জনপ্রিয় হওয়াদের একজন হলেন পাশ্চাত্যের কবি ফিটসজেরাল্ড। তার অনুবাদ আবার অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বাংলাতেও বেশিরভাগ রুবাইয়াৎ এসেছে ফিটসজেরাল্ডের অনুবাদকে ভিত্তি করে। মূল ফারসির বদলে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করায় ফিটসজেরাল্ডের ভ্রান্তির প্রভাব পড়েছে বাংলা অনুবাদগুলোয়।

খৈয়ামের রুবাইয়ে মদ বা সুরার কথা এসেছে ভাবার্থে। কিন্তু অনুবাদগুলোতে এগুলোর অর্থ করা হয়েছে আক্ষরিকভাবে। আর এতেই খৈয়াম চিত্রিত হয়েছেন মদারুরূপে।

কীভাবে? 

খৈয়ামের লেখা বিখ্যাত একটি রুবাইঃ

তুঙ্গী মেই লাল খোহাম ব দিওইয়ানি

সদ্দ রমকী বায়েদ ব নিফসে নানী

ওয়ানগাহ মান ব তু নিশততে দরবরানী

খোশতর বুদ আয মামলাকাতে সুলতানী

ফিটসজেরাল্ড এটার অনুবাদ করেছেন- 

Here with a Loaf of Bread beneath the Bough, 

A Flask of Wine, a Book of Verse - and Thou 

Beside me singing in the Wilderness – 

And Wilderness is Paradise enow.

 

এ-থেকে মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অনুবাদ করেন-

চুমুক খানিক লাল মদিরা আর গজলের একটি কিতাব

জান বাঁচাতে দরকার মতো একটুখানি রুটি কাবাব

তোমায় আমায় দুজনেতে বসে প্রিয়, নির্জনেতে

এ সুখ ছেড়ে রাজ্য পেলেও কিছুতেই সে বলব না লাভ!

 

সিকান্দর আবুজাফরকৃত অনুবাদ-

বনচ্ছায়ায় কবিতার পুঁথি পাই যদি একখানি

পাই যদি এক পাত্র মদিরা, আর যদি তুমি রাণী

সে বিজনে মোর পার্শ্বে বসিয়া গহো গো মধুর গান

বিজন হইবে স্বর্গ আমার, তৃপ্তি লভিবে প্রাণ।

 

বইকেনা প্রবন্ধে বইকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী খৈয়ামের রুবাইটির নিচে লেখেন 

"রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত- যৌবনা- যদি তেমন বই হয়”

বিভ্রান্তিটা বেঁধেছে ঠিক এখানেই! 

মুজতবা আলী কোনো আক্ষরিক বা কাব্যিক অনুবাদে না দিয়ে নিজের মতামতটিই এখানে ব্যক্ত করেছেন আর তাকেই পাঠক ধরে নিয়েছেন রুবাইয়ের ভাবানুবাদ হিসেবে। অন্যদের অনুবাদে মদিরা, সুরা- মদের এই সমার্থকগুলো ঠিক নেশাদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে কিনা সেই চিন্তাতেও যেতে চান না তারা। 

“বই পড়া আমার নেশা”- এই বক্তব্যে নেশা বলতে ক্ষতিকর অভ্যাসের পরিবর্তে আগ্রহের আধিক্য বোঝানো হয়েছে, এটা বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না। তেমনি খৈয়ামও আক্ষরিক অর্থে মদের কথা বলেন নি। তিনি খুব সাদামাটা ভাষায় বলেছেন এক জীবনে প্রশান্তির জন্যে কতটুকু প্রয়োজন!

তাই আসুন অপপ্রচারের বিপরীতে মহান এই ব্যক্তিকে দেই তার প্রাপ্য মর্যাদা

সেলজুক যুগে ১০৪৮ সালের ১৮ মে বর্তমান ইরানের নিশাপুরে তার জন্ম। যুবা বয়সে তিনি সমরখন্দে চলে যান লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে। এরপর বোখারায় নিজেকে মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১১৩১ সালের ৪ ডিসেম্বর নিজ জন্ম শহরে। 

আজ কিংবদন্তি কবি, গণিতবেত্তা, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিদ ওমর খৈয়ামের ৯৭৬তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে আমরা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই মহান মানুষটির প্রতি।