ইবনে সিনা : রোগ নিরাময়ে মনের ভূমিকার কথা প্রথম বলেন যিনি

অদ্ভুত রোগে আক্রান্ত পারস্যের রাজকুমার 

নিজেকে ভাবছে একটা গরু! খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। গরুর মতো হাম্বা হাম্বা ডাকে; জনে জনে ফরিয়াদ জানায়, 'আমি একটা গরু। আমাকে তোমরা জবাই করো!' 

অনেক চেষ্টার পরও যখন রাজকুমার ঠিক হচ্ছিল না তখন দায়িত্ব নিলেন আঠারো বছরের এক তরুণ চিকিৎসক। রাজকুমারকে জবেহ করতে বড় একটা ছোরা ধরলেন তার গলায়। ধরেই আবার সরিয়ে ফেললেন। বলতে লাগলেন, 'নাহ! এত শুকনো গরু জবাই করে কোনো লাভ নেই! একদম মাংস নেই। একে আগে খাইয়ে দাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করা হোক। তারপর জবাই করা যাবে!'

রাজকুমারেরও মনে হলো, 'আরে তাই তো!' সে বেশি বেশি খেতে লাগলো। এতে তার অপুষ্টি কেটে গেল। ভালো হয়ে গেল মনোবৈকল্যও। 

ডাক্তার ঠিক বুঝেছিলেন- রাজকুমারের মনোবৈকল্য ওষুধে সারবে না, লাগবে মানসিক প্রক্রিয়া। 

এই তরুণ চিকিৎসক হলেন ইবনে সিনা!  

পাশ্চাত্যে যিনি পরিচিত আভিসিনা (Avicenna) নামে। তাকে বলা হয় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক। জ্ঞানচর্চাকে তিনি স্থান দিয়েছিলেন পার্থিব সবকিছুর ওপরে। সুলতান মাহমুদের সুবিশাল গ্রন্থাগারে নাওয়া খাওয়া ভুলে ডুবে যেতেন বইয়ের ভেতর। 

এরপর তিন বছরের অর্জিত জ্ঞান, মেধা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেই শুরু করেন বই লেখা। চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে লেখেন চল্লিশটির মতো বই, যেগুলো বদলে দিয়েছিল তৎকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থাকে। 

‘আলকানুন ফিল তিবব’ বইটি তখন সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছিল। বইটির ল্যাটিন অনুবাদ হয় The Canon of Medicine নামে। মেডিকেল এনসাইক্লোপিডিয়ার ক্ষেত্রে একটি মনুমেন্টাল গ্রন্থ এটি, যা ইউরোপে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পাঠ্যবই ছিল পাঁচশ' বছর!

‘কিতাব আল শিফা’- দেহের সুস্থতায় মনের প্রভাবের প্রথম ব্যাখ্যা

সাইকোলজি বা মনোবিজ্ঞান মেডিকেল সায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ৬০-৭০ বছর ধরে। অথচ দেহের সুস্থতায় মনের প্রভাবের কথা ইবনে সিনা বলেছেন এক হাজার বছরেরও আগে তার বই ‘কিতাব আল শিফা'য়। 

এই বইটিকে তার সবচেয়ে মহৎ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে মজার বিষয় হলো ইংরেজিতে ‘দ্য কিউর’ তথা ‘নিরাময়ের বই' হলেও এটি কিন্তু ঔষধের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়! এটি মূলত বিজ্ঞান এবং দর্শন বিশ্বকোষ। সুস্থ থাকতে হলে যে মন এবং আত্মাকে সুস্থ রাখতে হবে- এমনটাই বলা হয়েছে কিতাব আল শিফায়।

কুড়ি খণ্ডের এই বিশাল গ্রন্থের প্রায় পুরোটাই তিনি লিখেছেন কোনোরকম রেফারেন্স ছাড়া! 

স্রেফ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি লেখেন, দৈহিকভাবে অসুস্থ মানুষ শুধু ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সুস্থতা অর্জন করতে পারে। সেই সুরে সুর মিলিয়ে এখন বিজ্ঞানও বলছে, আমাদের ৭৫ ভাগ রোগ নিরাময়ে ওষুধের দরকার নেই, মনের ইচ্ছাই যথেষ্ট! 

উল্লেখ্য, ইবনে সিনা-ই প্রথম, যিনি দেহের ওপর মনের প্রভাবের কথা ব্যাখ্যা করে বলেছেন। তিনি তা করেন সূরা বনি ইসরাইলের ৮২ নম্বর আয়াত অনুসারে, যেখানে বলা হয়েছে- বিশ্বাসীর জন্যে কোরআন হচ্ছে শেফা এবং রহমত স্বরূপ

এখানে আরবি 'শেফা' শব্দের ব্যাখ্যা নিয়েই কিতাব আল শিফা।

আসলে শেফা বা নিরাময় একটি ব্যাপক বিষয়

প্রফেসর হ্যান্স ওয়ের-এর আরবি-ইংরেজি ডিকশনারি এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে যথার্থ এবং পরিপূর্ণ আরবি টু ইংরেজি ডিকশনারি হিসেবে গণ্য। এতে আরবি 'শেফা' শব্দের অনুবাদ করা হয়েছে 'To cure somebody of a disease, to heal a disease or wound, to make somebody well, to restore to health, to recover, to bring a person back to health, to quench one’s thirst, to gratify one’s desire'.

অর্থাৎ, শেফা বা নিরাময় হলো- কাউকে রোগমুক্ত করা, রোগ অথবা আহত অবস্থা থেকে নিরাময় করা, ভালো করা, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা, রোগমুক্ত করে একজনকে সুস্বাস্থ্যের দিকে নিয়ে আসা, কারও তৃষ্ণা নিবারণ করা, চাওয়া বা ইচ্ছা বা মনছবি বা লক্ষ্য পূরণ করা।

সব মিলিয়ে বলা যায়, শারীরিক মানসিক আত্মিক সামাজিক যত রকম রোগ বা ব্যাধি, নেতিবাচকতা, বিকৃতি বা বিকার আছে, তা থেকে মুক্তিই হচ্ছে শেফা। আর সকল ধরণের নিরাময় রয়েছে পবিত্র কোরআনে।

ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মানুষ সুস্থ হতে পারে!

ইবনে সিনা নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, মন দেহকে প্রভাবিত করে সবচেয়ে বেশি। মনের আবর্জনা, ক্ষত, ব্যাধি- এগুলোা দূর হলে একজন মানুষ সুস্থ হয়ে যায়। তাই দৈহিকভাবে অসুস্থ কেউ শুধু ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সুস্থতা অর্জন করতে পারে।

আবার সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যেতে পারে যদি সে মনের দিক থেকে ভীতসন্ত্রস্ত বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। 

কিতাব আল শিফায় তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ভয়ের মতো শক্তিশালী আবেগ দেহের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দিতে পারে; যা কারণ হতে পারে রোগগ্রস্ততা, এমনকি মৃত্যুরও।

ইবনে সিনা ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন তক্তার উদাহরণ দিয়ে 

মাটির ওপর একটি ছয় ইঞ্চি চওড়া তক্তা বিছিয়ে যদি কাউকে বলা হয় এর ওপর দিয়ে হেঁটে যান, তিনি হয়তো দৌঁড়ে যাবেন। কিন্তু এই তক্তাই যদি ভূমি থেকে একশ' ফুট ওপরে দুই ভবনের ওপর বসিয়ে কাউকে এর ওপর দিয়ে হেঁটে পার হতে বলা হয়, দেখা যাবে তার গলা শুঁকিয়ে গেছে, হাত-পা কাঁপছে। কাঁপতে কাঁপতে হয়তো পড়েই যাবেন নিচে!

এই নিচে পড়ে যাওয়ার জন্যে না তো দায়ী তার পা, না সেই তক্তা। দায়ী আসলে তার মনের ভয়! 

বিষয়টিকে ইবনে সিনা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- This is because he pictures to himself a possible fall so vividly that the natural power of his limbs accords with it.

অর্থাৎ সেটা পার হওয়ার সময় সে কল্পনার চোখে দেখে নির্ঘাৎ নিচে পড়ে যাবে; পড়ে গেলে কী হতে পারে- এই কাল্পনিক চিত্রটা তার মস্তিষ্কে এতটাই স্পষ্ট হয় যে তার পা স্বাভাবিক চলার শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং সে পড়ে যায়।

উল্লেখ্য, সুস্থতার জন্যে মননিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বোঝাতে এই তক্তার উদাহরণই তিন দশক ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে কোয়ান্টাম মেথড কোর্সে।