জীবন বদলের চাবিকাঠি অটোসাজেশন : কতখানি কার্যকর? কীভাবে চর্চা করবেন?

published : ১৫ মে ২০২২

জীবন বদলায় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে। আর দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় বিশ্বাসের আলোকে। আপনি যা হতে চান সেটা আপনি হবেন যদি এ-ব্যাপারে পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখেন। আর বিশ্বাসকে অটল-অনড় করতে মোক্ষম হাতিয়ার হলো অটোসাজেশন।

কথায় বলে ‘ছোট মরিচের ঝাল বেশি!’ অটোসাজেশনও তা-ই। ছোট ছোট কথা বা অল্প কিছু শব্দ বার বার উচ্চারিত হয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্বাস ও শক্তির এক অন্ত-অনুরণন, যা জন্ম দেয় নতুন বাস্তবতা।

অটোসাজেশন কী?

আক্ষরিক অর্থে অটোসাজেশন হলো নিজেই নিজেকে পরামর্শদান। আপনি জীবনে যা হতে চান, যা করতে চান বা নিজের মধ্যে যে পরিবর্তনটি দেখতে চান তাকে ছোট ছোট কিছু কথায় রূপ দিয়ে গভীর মনোযোগ ও বিশ্বাসের সাথে বারংবার নিজেই নিজেকে বলার নামই অটোসাজেশন।

ধরুন, আপনার স্মৃতিশক্তি বেশ দুর্বল; কিন্তু আপনি চান প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে। ‘প্রতিদিন আমার স্মৃতিশক্তি বাড়ছে’ বা ‘আমার স্মৃতি অত্যন্ত নিখুঁত; তাই যখন যা প্রয়োজন তখন তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মনে করতে পারছি’- কথাগুলো গভীর প্রত্যয়ের সাথে বার বার আওড়ালে ধীরে ধীরে আপনার স্মৃতিশক্তি বাড়তে থাকবে।

ব্যক্তিত্ব উন্নয়ন, লেখাপড়া ও পেশাগত সাফল্য, রোগ নিরাময় ও সার্বক্ষণিক সুস্থতা- অটোসাজেশন প্রয়োগ করে সুফল পেতে পারেন সবগুলো ক্ষেত্রেই।

যেভাবে এলো

ডা. এমিল কোয়েই সম্ভবত প্রথম সফলভাবে অটোসাজেশন প্রয়োগ করেন। এই ফরাসী মনোবিজ্ঞানী বিশ শতকের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেন ওষুধ ছাড়াই একের পর এক রোগীকে ভালো করার মাধ্যম।   

১৯১০ থেকে ১৯২৬ হাজার হাজার মানুষকে তিনি সুস্থ করেছেন মাইগ্রেন, মাথাব্যথা, বাতব্যথা, অ্যাজমা, প্যারালাইসিস, তোতলামি, টিউমার, গ্যাস্ট্রিক, আলসার ও অনিদ্রা থেকে।

না, কোনো ওষুধ লাগে নি! এ-কাজে ডা. কোয়ে প্রয়োগ করেন অটোসাজেশন।

কেউ একই ভালো কথা বার বার বললে ভালো জিনিসগুলোই তার দিকে আকৃষ্ট হয়- এই তত্ত্বের আলোকে তিনি নির্মাণ করেন অটোসাজেশন- Day by day, in every way, I am getting better and better!

সকাল-বিকাল একাগ্র মনোযোগ দিয়ে কথাটি ২০ বার করে বলতো তার রোগীরা। ব্যস, কিছুদিনের মধ্যেই রোগ উধাও! 

বাংলাদেশে অটোসাজেশনের পথিকৃত প্রফেসর এম ইউ আহমেদ

তিনি অটোসাজেশন প্রথম প্রয়োগ করেন খোদ নিজের ওপর! ১৯৩৪ সালে প্যারাটাইফয়েডে আক্রান্ত হন তিনি। ৪ মাস মিটফোর্ড হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তাররা তার বাঁচার আশা বাদ দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন।

ঢাকা থেকে নৌপথে গ্রামের বাড়ি বরিশাল; নৌকায় উঠেই তিনি বাঁচার মন্ত্র পেলেন। অন্তর থেকে বার বার বলতে লাগলেন-‘আমি বাঁচতে চাই! আমি বাঁচবো!’ বাড়ির ঘাটে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই তিনি দিব্যি সুস্থ!  

একই প্রক্রিয়ায় ১৯৭৩ সালেও ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ অবস্থা থেকে বেঁচে ওঠেন তিনি।

প্রফেসর আহমেদ অটোসাজেশন দিয়ে তিন দশকে হাজারো রোগীকে সুস্থ করেছেন বিভিন্ন জটিল ব্যাধি থেকে।

তবে অটোসাজেশনের ধারণা ১৪০০ বছরের পুরনো!  

নবীজীর (স) একটি হাদীস হলো, কারো সাথে দেখা হলে সালাম বিনিময়ের পর কুশল জিজ্ঞেস করলে বলবে, ‘শোকর আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভালো আছি!’

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাবে কথাটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য তখন বোঝা না গেলেও মনোবিজ্ঞানীরা বুঝতে শুরু করেন বিশ শতকে এসে। নবীর এই শিক্ষাটিই আসলে একটি অটোসাজেশন! যা মানুষকে সাহায্য করে সর্বাঙ্গিন ভালো থাকতে।  

ধরুন, দিনে ২০ জন মানুষের সঙ্গে আপনার দেখা হলো, কুশল জিজ্ঞাসায় বললেন, ‘বেশ ভালো আছি!’ এভাবে প্রতিদিন ২০ বার করে আপনার মস্তিষ্কে ভালো থাকার বাণী যাবে, মস্তিষ্কে তৈরি হবে ভালো থাকার তরঙ্গ। ফলশ্রুতিতে ভালো থাকবেন আপনি।

ভাবছেন, সামান্য কিছু শব্দ কীভাবে জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে!  

এ রহস্যও বিজ্ঞানীরা আস্তে আস্তে উন্মোচন করেছেন। ক্লিনিকেল সাইকোলজিস্টরা গবেষণা করে দেখেছেন, মানুষের নার্ভাস সিস্টেম বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে কোনো তফাত করতে পারে না। বাস্তবে একটি ঘটনা দেখলে যে ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয়, সেই একই ব্রেন ওয়েভ সৃষ্টি হয় ঘটনাটি কল্পনা করলে।

উদাহরণ দেই-

সিনেমায় নায়ক-নায়িকার কষ্ট দেখে চোখের জলে বুক ভাসান অনেকেই। কমেডি দৃশ্য দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন; উঁচু টাওয়ার থেকে কাউকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখে বুকটা ছলাৎ করে ওঠে। আবার ভৌতিক দৃশ্য দেখলে দাঁড়িয়ে যায় গায়ের লোম।

এর সবগুলোই স্রেফ অভিনয়, বাস্তবে কিছুই ঘটছে না- এটা জানার পরও শারীরিক প্রতিক্রিয়াগুলোর কারণ হলো ব্রেন এগুলোকে সত্যি বলে ভেবেছে। এই ব্যাপারটিকেই মনোবিজ্ঞানীরা কাজে লাগাচ্ছেন কখনো অটোসাজেশনে, কখনো মনছবিতে।

নিউরোসায়েন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে

আমাদের মস্তিষ্ক সুপার কম্পিউটারের চেয়েও কমপক্ষে দশ লক্ষগুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। মস্তিষ্কের ১০০ বিলিয়ন নিউরোনের একটি আরেকটির সাথে সংযুক্ত। এই সংযোগ পথকে বলা হয় ডেনড্রাইট। নিউরোসাইন্টিস্টরা দীর্ঘ পরীক্ষায় দেখেছেন, যখনই মস্তিষ্কে নতুন তথ্য যায়, নতুন ডেনড্রাইট তৈরি হয়। ক্রমাগত একই তথ্য যেতে থাকলে মস্তিষ্কের কর্মকাঠামো বদলে যায়। মস্তিষ্ক তখন এই নতুন বাস্তবতা সৃষ্টিতে লেগে পড়ে।

অটোসাজেশনে বারংবার বলা একই কথা মন ও মস্তিষ্কের বিশাল শক্তিভাণ্ডারকেই সক্রিয় করে তোলে; মনোদৈহিক প্রক্রিয়া প্রস্তুত হয় চাওয়াকে পাওয়ায় রূপান্তরে। ফলে বদলে যায় বাস্তবতা।

কীভাবে চর্চা করবেন?

অটোসাজেশন চর্চা করা খুবই সহজ। এজন্যে আগে ঠিক করতে হবে আপনি আসলে কী চান বা কোন দিকটিতে পরিবর্তন আনবেন। চাওয়া ঠিক হলে শুরু করুন চর্চা।

প্রয়োজনমাফিক শব্দ বা বাক্য দিয়ে আপনি নিজেই বানিয়ে নিতে পারেন আপনার অটোসাজেশন। স্বাচ্ছন্দমতো বর্তমান বা ভবিষ্যৎ কালজ্ঞাপক শব্দ থাকতে পারে। যেমন, 'করব', 'হবে' বা 'থাকবে' বলতে পারেন। অথবা বলতে পারেন 'করছি', 'হচ্ছে' বা 'থাকছে'।

তবে খেয়াল রাখবেন শব্দগুলো যেন ইতিবাচক হয়। যেমনঃ ‘আমার মাইগ্রেন ভালো হয়ে যাবে’ না বলে বলুন- ‘আমার মাথা হালকা ও ফুরফুরে লাগছে, ‘আমার হৃদরোগ ভালো হবে’ না বলে বলুন ‘আমার হৃদপিণ্ড ভালভাবে কাজ করছে’ ইত্যাদি।  

‘জীবন বদলের চাবিকাঠি অটোসাজেশন’

বইটি থেকেও নির্বাচন করতে পারেন আপনার অটোসাজেশন।

অটোসাজেশন মেডিটেশনের মধ্যে বা স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় দিতে পারেন। চর্চা করতে পারেন কাজের ফাঁকেও।   

যত আন্তরিকভাবে অটোসাজেশন অনুশীলন করবেন ততো আপনার মনোদৈহিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হবে নতুন অন্ত-অনুরণন, নীরবে-নিঃশব্দে ভেতর থেকেই বদলাতে শুরু করবেন আপনি। বদলে যাবে আপনার জীবন।