মেডিটেশনের বছর ২০২৫-এ আসুন মেডিটেশনকে কাজে লাগাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে

published : ২১ জানুয়ারি ২০২৫

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় জনস্বাস্থ্য এজেন্সি The Centers for Disease Control and Prevention (CDC) কোভিড ১৯ অতিমারির কারণে ছাত্রদের ক্ষতিগ্রস্ত মানসিক স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে স্কুলগুলোয় মেডিটেশন চালু করতে বলেছে। তাদের মতে, মেডিটেশন চর্চা শিক্ষার্থীদের রোজকার স্ট্রেস মোকাবেলায় সাহায্য করবে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো রাখবে। 

এদিক থেকে আমরা এগিয়ে আছি! বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মেডিটেশন ও ইয়োগা সম্বলিত টোটাল ফিটনেস প্রোগ্রাম চালু হয়েছে আরও দু’বছর আগে, ২০২২ সালে। 

আরো একটি দিক থেকে আমরা আন্তর্জাতিক উদ্যোগের চেয়ে এগিয়ে আছি, আর তা হলো মেডিটেশন দিবস পালন। গত ২৯ নভেম্বর ২০২৪ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত প্রস্তাবে ২১ ডিসেম্বরকে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আর কোয়ান্টাম ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালন করছে ২০২১ সাল থেকে। 

২০২৫ সালকে তো কোয়ান্টাম ঘোষণাই করেছে ‘দ্য ইয়ার অব মেডিটেশন’ বা মেডিটেশনের বছর হিসেবে!

জাতিসংঘের বিশ্ব মেডিটেশন দিবস পালনের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মেডিটেশনের গুরুত্ব ও ভালো থাকার জন্যে এর কার্যকারিতারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। ৩২ বছর ধরে ভালো থাকার জন্যে মেডিটেশনের প্রয়োজনীয়তার কথা আমরা বলছিলাম, সেটাই প্রতিধ্বনি হচ্ছে এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। মেডিটেশনের বছর ২০২৫-এ তাই অঙ্গীকার হোক জীবনের প্রতিটি কল্যাণকর প্রয়োজন পূরণে মেডিটেশনকে প্রয়োগ করব আমরা।

আসলে আমরা যে বলি ‘পাওয়ার অফ মেডিটেশন’, এই পাওয়ারটাকে অনুধাবন করতে হবে। যে এটা সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পারে তার জীবনটা সহজ হয়ে যায়। কারণ মেডিটেশনকে প্রয়োগ করে সে তার জীবনের সমস্যাগুলোকে সমাধান করতে পারে। 

মেডিটেশন বলা যেতে পারে ‘সুইস নাইফ’

সুইস নাইফ চেনেন তো! সুইস আর্মি নাইফ হচ্ছে ভাঁজ করা যায় এমন এক ধরণের ছুরি, যেটার সাথে আছে একগুচ্ছ টুলস, যেমন স্ক্রু ড্রাইভার, ক্যান ওপেনার, কাঁচি, করাত ইত্যাদি। এই সুইস নাইফ দিয়ে মোট ১৯ ধরণের কাজ করা যায়। সহজে সাথে করে যে-কোনো জায়গায় নিয়েও যাওয়া যায়।  

মেডিটেশনকেও আপনি বলতে পারেন সুইস নাইফ। যে-কোনো সময় যে-কোনো জায়গায় নিজের কল্যাণ এবং অন্যের কল্যাণে যে-কোনোকিছুর জন্যে আপনি একে কাজে লাগাতে পারেন। হাতে সুইস নাইফ থাকার পরও যদি আপনি অন্য নাইফ খোঁজেন সেটা যেমন বোকামি হবে, একই অবস্থা হবে যদি সমস্যা সমাধানে মেডিটেশন থাকতে অন্য কিছু খোঁজেন। 

মেডিটেশনকে কী কী কাজে লাগানো যায়?

অনেক কাজে! বোঝার সুবিধার্তে কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাকঃ 

সহজে পড়া মনে রাখার জন্যে 

সকালে মেডিটেশন করুন। আজ যে বইগুলো আপনি পড়বেন তা মনের বাড়িতে বসে মনের পর্দায় দেখুন।

ধরুন আপনি ফিজিক্স পড়বেন। যে চ্যাপ্টারটা পড়বেন, মেডিটেটিভ লেভেলে সেটার পাতাগুলো ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত দেখে যান ৩/৪/৫ বার। পুরো পাতাটা পড়ে ফেলুন খুব দ্রুত, এক নজরে। অনুভব করুন যে যা দেখছেন তা বুঝতে পারছেন, যখন বাস্তবে পড়বেন তখন দ্রুত পড়তে পারবেন এবং সমস্ত জিনিস আপনার অন্তরে চলে আসবে। 

যখন পড়তে বসবেন, আবার মেডিটেশন করুন। মনের বাড়িতে চলে যান। সকালের মেডিটেশনে পড়ার স্মৃতি স্মরণ করুন। মনে মনে বলুন, আমি এখন ফিজিক্স বইয়ের এই অধ্যায় পড়ব এবং রিভাইজ করব। খুব দ্রুত আমি বুঝতে পারব, পড়তে পারব, মনে রাখতে পারব এবং যা প্রয়োজন যখন প্রয়োজন লিখতে ও বলতে পারব। তারপরে বাস্তবে চোখ মেলে বাম হাতে কোয়ান্টা ভঙ্গি করে পড়ুন। দেখবেন পড়া কত সহজে আয়ত্ত করতে পারছেন!

 

পরীক্ষায় ভালো লেখার জন্যে

পরীক্ষা শুরুর ৫ মিনিট আগে ছোট্ট করে মেডিটেশন করুন। মনের পর্দায় দেখুন আপনি যা ভালোমত পড়েছেন তা পরীক্ষায় এসেছে, আপনি উত্তরপত্রে গুছিয়ে উত্তর লিখছেন। বাস্তবে যখন পরীক্ষা দেবেন তখন দেখবেন যে চমৎকারভাবে লিখতে পারছেন, ভেতর থেকে লেখায় ফ্লো চলে এসেছে।

 

চাকরির ইন্টারভিউতে ভালো করার জন্যে 

ইন্টারভিউ বোর্ডে যারা থাকবেন সেই বসদের সাথে মনের বাড়িতে বসে ইন্টারভিউ দিন। দেখুন তারা কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে, আপনি গুছিয়ে তার উত্তর দিচ্ছেন। ১৫ দিন এভাবে রিহার্সেল দিন। তবে খেয়াল রাখবেন যেন একজন ইন্টারভিউয়ার একেক সময় একেক প্রশ্ন না করে।   

বাস্তবে দেখা যাবে যে স্যার এদিক সেদিক হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রশ্ন একই! কারণ মেডিটেশনে আপনি মেন্টাল মেসেজিং করেছেন। 

 

বিজনেস প্রপোজালের ক্ষেত্রে 

কাউকে বিজনেস প্রপোজাল দিতে যাবেন। সকালে উঠে মেডিটেশনে বসুন। যাকে প্রস্তাবটা দেবেন, নিজের ভেতর ডুবে গিয়ে তার চেহারা ভিজুয়ালাইজ করুন। দেখুন আপনি তার কাছে গেছেন, তিনি আন্তরিকভাবে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। হাসিমুখে আপনার কথা শুনছেন। আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং আপনাকে কন্ট্রাক্ট দিচ্ছেন বা পেমেন্ট করছেন। 

অর্থাৎ, বাস্তবে আপনি যা করবেন সকালবেলাতেই মেডিটেশনের এটার রিহার্সেল দিন। দেখবেন সুন্দর বিজনেস ডিল হয়ে যাবে।

 

ব্যবসায় উন্নতির জন্যে 

মেডিটেশনে অবলোকন এবং অনুভব করুন যে আপনার দোকানে প্রচুর কাস্টমারের ভিড়। আপনি যে মালামাল আনছেন দ্রুত তা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। আপনার প্রচুর উপার্জন হয়েছে, আপনি টাকা গুনছেন।

নিয়মিত এই মনছবি দেখার সাথে সাথে খেয়াল রাখবেন যা বিক্রি করবেন সেই জিনিসটা যেন ভালো হয়। 

 

চর্মরোগ নিরাময়ে 

স্কিনের যত রোগ আছে তার সবই সাইকোসোম্যাটিক। আপনার চর্মরোগ আছে মানে হলো আপনার ভেতরে অস্থিরতা আছে, কষ্ট আছে। এই অস্থিরতা দুঃখ কষ্ট ঝেড়ে ফেললে আপনার সমস্যা দূর হয়ে যাবে। এজন্যে মেডিটেশনে ধ্যানের স্তরে গিয়ে আপনার সকল কষ্ট বা সমস্যার কথা কাগজে লিখুন। এরপর সবগুলো কাগজ পানিতে ফেলে দেন।

স্কিন ডিজিজ থেকে ফোঁড়া বা পাঁচড়া হয়ে গেছে? মেডিটেশনে নিরাময় কক্ষে যান। ওখানে নিরাময়ের মনছবি করুন। দেখুন, ফোঁড়া বা পাঁচড়ায় ছোট ছোট পোকা, ছোট ছোট পাখি এসে পোকাগুলোকে ধরে খুব আনন্দের সাথে খেয়ে নিচ্ছে। ফোঁড়া বা পাঁচড়ার আয়তন আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এসছে। এভাবে নিয়মিত মনছবি করুন, ইনশাআল্লাহ্‌ ঘা পাঁচড়া থাকবে না।

আরো কিছু রোগ নিরাময়ে মনছবি করার টেকনিক জানতে এই পেইজটি ভিজিট করুন- রোগ নিরাময়ে মনছবি

নিজের পাশাপাশি অন্যের রোগ নিরাময়েও আপনি মেডিটেশনকে কাজে লাগাতে পারেন। পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানুন এই লিংকে গিয়ে - কমান্ড সেন্টারে অন্যের নিরাময় প্রণালী 

 

দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নয়নে 

স্বামী/স্ত্রীর সাথে মন কষাকষি হয়েছে, কথা বন্ধ? বিটা লেভেলে কিছুতেই মন গলাতে পারছেন না? 

আসলে ঝগড়াঝাঁটিতে সমস্যা হয় চেইন ফ্ল্যাশব্যাক। ধরুন একটা ব্যাপার নিয়ে হাজবেন্ড ওয়াইফ ঝগড়া হলো; আপনি রেগে দুর্ব্যবহার করলেন। সাথে সাথে অপরপক্ষের শুরু হবে চেইন ফ্ল্যাশব্যাক। এর আগে কতবার আপনি রেগেছিলেন, কোথায় রেগেছিলেন, রেগে কী কী করেছিলেন- ব্রেনে চেইন ফ্ল্যাশব্যাক হতে থাকবে সেসবের। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ফ্ল্যাশব্যাক হওয়াটা বন্ধ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অপরপক্ষের মেজাজ ঠান্ডা হবে না। এই ফ্ল্যাশব্যাক বন্ধ করার জন্যে আপনাকে ফ্ল্যাশব্যাকের চ্যানেলটা বদলে দিতে হবে। 

এজন্যে নিয়মমাফিক মনের বাড়িতে যান। স্বামী/স্ত্রীর সাথে আপনার যে আনন্দের মুহূর্তগুলো ছিল তাকে সেই আনন্দের দৃশ্যগুলো মনে করিয়ে দেন। স্বামী/স্ত্রী যত রাগই করে থাকুক ঐ আনন্দের ছবিগুলোই তখন রিফ্লেক্স হবে তার মনে। সে অনুভব করবে, রাগারাগি বা দুর্ব্যবহার করেছিলাম- শুধু এটাই সত্য না, আমাদের একসাথে অনেক সুন্দর স্মৃতিও আছে। 

এভাবে যত গভীর থেকে ভাববেন তত তার ভেতরকার নেগেটিভ ফ্ল্যাশব্যাক রিফ্লেক্সড হয়ে যাবে নতুন পয়েন্ট দিয়ে। এরপর শুধু বাস্তবে তাকে এপ্রোচ করবেন, দেখবেন অপরপক্ষের মন গলে গেছে।

 

সন্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে

আপনার সন্তান আপনার কথা শুনতে চায় না? তাকে মনের বাড়িতে নিয়ে আসুন, মায়ের/বাবার মমতা দিয়ে বোঝান। বিটা লেভেল যে কথাগুলো তাকে শোনাতে চান দরদের সাথে সেগুলো তাকে বলুন। 

১/২ দিনে হয়ত হবে না। কারণ সন্তান তো ১/২ দিনে বখে যায় নি! অতএব, হাল ছেড়ে দেবেন না। ধৈর্য নিয়ে তাকে বোঝাতে থাকুন। যত ধৈর্য, আন্তরিকতা আর মমতা নিয়ে তাকে বোঝাবেন দেখবেন ধীরে ধীরে সে আপনার কথা শুনতে শুরু করেছে।  

 

ভিসার ইন্টারভিউতে ভালো করার জন্যে 

খোঁজখবর নিন যে ভিসা কাউন্টারে কে থাকে। আসলে ভিসার ইন্টারভিউতে যে ভিসা অফিসার ইন্টারভিউটা নেন উনি কিন্তু মূল বিষয়। বাকি কাগজপত্র তো আপনি ঠিকঠাক করেছেনই। এখন শুধু ওই ভিসা অফিসারকে ইমপ্রেস করতে হবে। 

তো তাকে মনের বাড়িতে নিয়ে আসুন, ২/৩/৪ দিন বসুন তাকে নিয়ে। কেন আপনাকে ভিসা দিতে হবে তা বুঝিয়ে বলুন। ভিসা না দিয়ে সে যাবে কোথায়! 

 

বিয়ের ব্যাপারে 

বিয়ের বয়স হয়ে থাকলে মনছবি করুন। বিয়ের মনছবির ক্ষেত্রে সবসময় ভালো মানুষ খোঁজ করবেন। ভালো চেহারা, রঙ ফর্সা, উচ্চতা- এসব না। 

আর যারা বিয়ে করতে চান সময়মতো করবেন, আগে প্রতিষ্ঠিত হই তারপর- না! প্রতিষ্ঠিত হতে হতে আপনার বয়স ৫০ বছর হয়ে যাবে, তখন আর পাত্রী খুঁজে লাভ নেই। আর মহিলাদের একটা বয়সের পর পাত্র মেলা কঠিন। 

মেডিটেশন দিনে কয়বেলা কতক্ষণ করতে হবে?

বলবেন অনেক ব্যস্ত! মেডিটেশন করার সময় পাই না- দুই বেলা মেডিটেশন কি করতেই হবে? হবে! আর তা আপনার ব্যস্ততার ফসল ঘরে তোলার জন্যেই।

যেমন ধরুন, দিনে আমাদের দু’বেলা দাঁত মাজতে হয়। একদিন বাদ গেলেই দেখবেন দাঁতের মাড়িতে ময়লা জমে গেছে। আর কয়েকদিন ব্রাশ না করলে তো দুর্গন্ধে আপনার কাছেই ঘেঁষা যাবে না!

আমাদের মনের অবস্থাও এমনই। রোজ দুবেলা মেডিটেশন করলে মনে আবর্জনা, অর্থাৎ নেতিবাচক ভাবনা জমে ভয় উদ্বেগ উৎকণ্ঠার রূপ নিতে পারে না। মাথা ঠান্ডা থাকে, ফোকাস ভালো হয়। ভালো ভাবা পরিণত হয় স্বভাবে; আর ভালো ভাবাটাই হচ্ছে ভালো থাকার মূল ভিত্তি।

এজন্যেই মেডিটেশন চর্চা করতে হবে দিনে দুবার। ৩০ মিনিট করে করতে পারলে খুব ভালো; না হলে অন্তত ১৫-২০ মিনিট করে হলেও করা উচিত।

আসলে মেডিটেশন হচ্ছে মনোশক্তিকে ক্রমাগত নিজের এবং অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যখন মেডিটেশন প্রয়োগ করবেন তখন আপনি সবসময় প্রো-একটিভ থাকবেন, আপনার মাইন্ড ফোকাসড থাকবে এবং বডি মাইন্ডের পুরো শক্তি একত্রিত হবে। সমস্ত অসম্ভব তখন হয়ে যাবে সম্ভব।