নারীদের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?

published : ৮ মার্চ ২০২১

৮ মার্চ, বিশ্ব নারী দিবস।

১১২ বছর আগে এই দিবসটি প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে।

এই দিনটিতে বিশ্বের প্রতিটি নারীই নিজের অনন্যতাকে অনুভব করেন একটু ভিন্নভাবে। শত শত বছর ধরে অবহেলা বঞ্চনার শিকার নারী আজ নিজ যোগ্যতা, গুণ ও ত্যাগের ফলেই সমাজে সম্মান লাভ করেছে, হয়েছে নন্দিত।

তবে জীবনের কিছু চিরায়ত মৌলিক অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সবসময় নারীর মনোযোগ দাবি করেছে এবং করবে। এই বিষয়গুলো সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা একজন নারী পথচলাকে করবে আরো গতিশীল ও মসৃণ।

নারী : শুধুই কি বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক?

যুগ যুগ ধরে সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে নারীকে হতে হবে নিখুঁত ও আবেদনময়ী। তা যতই অসামঞ্জস্যপূর্ণ হোক না কেন!

সৌন্দর্যের মানদণ্ড হিসেবে আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ফর্সা ত্বক, ঝকঝকে দাঁত, স্লিম ফিগার, ঢেউ খেলানো লম্বা কেশরাজি। আর হাসলে যদি গালে টোল পড়ে তাহলে তো কথাই নেই! যিনি সৌন্দর্যের এই প্রচলিত গ্রামারের মধ্যে পড়েন না, তাদের অধিকাংশই নিজেকে সুন্দরী মনে করেন না, এমনকি হীনম্মন্যতায় ভুগেন। অথচ এই হীনম্মন্যতা সুকৌশলে আমাদের সমাজে ঢুকিয়ে দেয়ার পেছনে রয়েছে একদল স্বার্থপর কুচক্রী ব্যবসায়ী দল।

বর্তমানে বাজার সয়লাব হয়ে আছে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম, হেয়ার রিমুভাল ক্রিম, রাজ্যের মেকআপ আইটেম এবং আকর্ষণীয় মোড়কে মোড়ানো বিভিন্ন বিউটি প্রোডাক্টে যার রয়েছে নানা ক্ষতিকর প্রভাব।

অনেক কসমেটিক্সে সীসা, ক্যাডমিয়াম, জিঙ্কের মতো ভারি ধাতুর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দীর্ঘমেয়াদে এসব পণ্য ব্যবহারের ফলে ত্বক রুক্ষ হয়ে ওঠে, হারিয়ে ফেলে স্বাভাবিক কমনীয়তা এমনকি হতে পারে স্কিন ক্যান্সার!

এমনকি সমাজের প্রতিষ্ঠিত অনেক নারীও হয়েছেন হীনম্মন্যতার করাল গ্রাসের শিকার। তাদেরই একজন বলিউডের প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী সোনম কাপুর।

২০১৮ সালে তিনি তার ব্লগে লিখেছিলেন আর দশটা কিশোরীর মতো আমিও কত রাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে থেকেছি! ১৫ বছর বয়সেও আমি জানতাম আমি কোনোদিন নায়িকাদের মতো নিখুঁত হতে পারব না। তাই যখন আমাকে একটি ছবির নায়িকা হিসেবে চূড়ান্ত করা হলো নিজেকে তারকা জগতের যোগ্য করে তুলতে কিছু অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুশীলন শুরু করলাম। একের পর এক নানান ধরনের ডায়েট মেনে চলতে থাকলাম। এমনও ডায়েট করেছি যেখানে দিনভর আমাকে শুধুই আনারস খেতে হয়েছে।

টিনএইজ বয়সের সেই মানসিক ভুলগুলোর কারণে আমাকে এখন এসিডিটির মতো অসুখে ভুগতে হচ্ছে আর জীবনভর হবে।

৩১ বছর বয়সে এসে আমি আমার শরীর ও গড়নকে ভালবাসতে শুরু করি। এখন আমি স্বাভাবিক সুস্থ জীবনযাপন করছি, স্বাস্থ্যকর খাবার খাই, ঠিক মতো ঘুমাই, ভোরবেলা উঠে নিজেকে প্রাণবন্তভাবে আবিষ্কার করি। সুস্বাস্থ্যই সৌন্দর্য এটাই এখন আমার উপলব্ধি।

অর্থাৎ, সৌন্দর্য কি সুস্বাস্থ্যে নাকি রোগা শরীরে- এ দুটোর তফাৎ বুঝতে হবে নিজেকেই।

আবার, দৈহিক ক্রুটি যে কোনোভাবেই একজন মানুষের আত্মবিকাশের পথে বাধা নয় তা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন কোটি মানুষের প্রেরণা হেলেন কেলার। তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও বাকশক্তি বিনষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস ও প্রচেষ্টা দিয়ে তিনি বাকশক্তি পুনরুদ্ধার করে, কথা বলতে শেখেন। কলেজ থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সফল বক্তা হিসেবে সারা দুনিয়ায় ঘুরে বেড়ান।

দৈহিক ত্রুটির কারণে যারা হতাশ হয়ে পড়েন, তাদের সামনে হেলেন কেলার আজও প্রেরণার আলোকবর্তিকা। (কোয়ান্টাম মেথড বই)

অনেক নারী আবার আকর্ষণীয় ফিগারের জন্যে বেছে নেন জিম ও ডায়েটিং যার রয়েছে ক্ষতিকর প্রভাব।

নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইলে আপনি কতটা খাচ্ছেন তার চেয়েও কী খাচ্ছেন তা অনেক বেশি। ফ্রেঞ্চফ্রাই, চিপ্স, বিভিন্ন রকম পানীয়, মিষ্টি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ওজন বাড়ায়। অন্যদিকে বাদাম, টক দই, তাজা ফলমূল, আঁশ-জাতীয় শাক-সব্জি এবং পূর্ণ শস্যদানা জাতীয় খাবার ওজন কমায়। মূল খাবারের কিছুটা আগে কোনো একটি ফল ও মুঠোভর্তি বাদাম খেয়ে নিলে ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করা যায় খুব সহজেই।

ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সর্বোপরি সুস্থতার জন্যে ব্যায়ামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’-এর মতে, সপ্তাহে ১৫০ মিনিট ব্যায়াম সুস্থতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। যেমন, প্রতিদিন অন্তত ২০ মিনিট করে হাঁটা কিংবা জগিংও। আর ব্যায়ামের মধ্যে সেরা ব্যায়াম হচ্ছে কোয়ান্টাম ব্যায়াম।

এছাড়াও নিয়মিত বঙ্গাসন চর্চা শরীরের বাড়তি ওজন দূর করে, পায়ের পেশি মজবুত করে মহিলাদের জরায়ু নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহের ক্ষয় রোধ করে এবং স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।

তাই স্রষ্টা প্রদত্ত স্বাভাবিক সুস্থ শরীরকে ভালবাসুন। নিজের চেহারা বা ফিগার নিয়ে অহেতুক হীনম্মন্যতায় না ভুগে নিজের বিশেষ দিকগুলো খুঁজে বেড়ান। স্রষ্টার অনন্য সৃষ্টি হিসেবে ভালবাসুন নিজেকে।  

বিয়ে: একটি দায়িত্ব, কোনো ফ্যান্টাসি না

মিডিয়ার কল্যাণে এখন বিয়ে হয়ে গেছে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান নির্ভর।

বিয়ের একটি দিনকে কেন্দ্র করে এনগেইজমেন্ট, মেহেদি সন্ধ্যা, গায়ে হলুদ, ব্রাইডাল শাওয়ার, প্রি-ওয়েডিং ফটোশুট, পোস্ট-ওয়েডিং ফটোশুটের ভিড়ে বিয়ের মূল উদ্দেশ্য কি সেটাই অনেকের কাছে অস্পষ্ট হয়ে গেছে।

বিয়ের পরে নতুন পরিবারের সবাইকে কীভাবে আপন করে নিবেন, কীভাবে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিবেন এমন বাস্তব চিন্তা থেকে অনেকটাই যেন দূরে সরে গেছেন বর্তমানের অনেক তরুণ তরুণী।

বিয়েতে ডিজাইনার লেহেঙ্গা পরব বা অমুক মেকআপ আর্টিস্টের কাছে সাজবো, বিয়ের আগে থেকেই এমন স্বপ্নে বিভোর থাকেন অনেক তরুণী। কিন্তু বিয়ের পরে যখন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তখন তা মেনে নেয়া অনেকের জন্যেই খুব কঠিন। তাই বিয়ের আগে থেকেই মানসিক প্রস্তুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থাৎ বিয়ে মানে শুধুই ভালবাসা, রোমান্টিসিজম কিংবা সাজসজ্জা নয়, এটি একটি দায়িত্ব। কিন্তু মিডিয়ার রঙিন জগতের প্রভাবে আমরা এটি ভুলে যাই। ফলে সিনেমা-নাটক টিভি-সিরিয়ালের অবাস্তব জীবনের সাথে আমরা অনেক সময় আমাদের বাস্তব জীবনকে মিলিয়ে ফেলি। ছেলেরা থাকে নায়িকার মতো সুন্দরী জীবনসঙ্গিনী ও মেয়েরা নায়কের মতো সুপুরুষ জীবনসঙ্গীর খোঁজে।

বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে এখন তরুণীরা সাধারণত বিয়ে করছেন পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বিয়ের অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবার গঠন ও সন্তান জন্মদান।

গবেষণায় দেখা গেছে, ২০-৩০ বছর বয়সকালটি সন্তান জন্মদানের জন্যে সর্বোত্তম সময়। ৩০ বছরের পরে সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময়ে নানা জটিলতা দেখা যেতে পারে। তাই ভবিষ্যতে দাম্পত্য জটিলতা এড়ানোর জন্যে বিয়ে করার সময় এই বিষয়গুলো বিবেচনা করা উচিত।

সংসার নাকি ক্যারিয়ার?

নারীকে বলা হয় দশভুজা। কেননা সমান তালে ঘরের ও বাইরের কাজ সামলানোর ক্ষমতা রয়েছে নারীর।

তবে আধুনিক যুগে সংসার এবং ক্যারিয়ারের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় অধিকাংশ নারীকেই।

একজন নারী যদি আর্থিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হতে চান তবে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

তবে চাকরিজীবী ও ক্যারিয়ারিস্ট হবার মাঝে একটি সূক্ষ্ম ফারাক রয়েছে।

একজন ক্যারিয়ারিস্টের ধ্যানজ্ঞান ক্যারিয়ার। তাই স্বাভাবিকভাবে পেশাই তার কাছে সবক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার পায়। তবে একজন নারী ক্যারিয়ারিস্টকে অনেক কিছু সেক্রিফাইস করতে হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য হচ্ছে এই সেক্রিফাইসের তালিকায় প্রথমেই থাকবে আপনার সন্তান ও পরিবার। কেননা একজন সফল ক্যারিয়ারিস্ট হতে হলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পারিবারকে পরিপূর্ণ সময় ও মনোযোগ দেয়া এক দুরূহ কাজ।

তাই, জব- ক্যারিয়ার- মা এই তিনের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্যকে সামনে রেখে নারীরা সিদ্ধান্ত নিলে পরবর্তীতে চলার পথ হয়ে উঠবে সুগম।

কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য সহজাত!

একবিংশ শতাব্দীতে এসে সারা বিশ্ব যেখানে নারীর অধিকার আদায়ে সোচ্চার, আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আরব দেশের ধু ধু মরুর প্রান্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নারীর মর্যাদা ও সম্মান, অধিষ্ঠিত হয়েছিল নারীর শিক্ষার্জন ও উপার্জনের অধিকার।

বর্তমানে নারীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায় দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হই। তবে এটা নতুন কিছু নয়। ১৪০০ বছর আগেও নারীরা রসুলুল্লাহর (স) নির্দেশে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, হয়েছেন শহিদ!

হযরত ওমরের শাসনামলে মদিনার মার্কেট ইন্সপেক্টার ছিলেন একজন নারী। বাজারের জিনিসপত্রের গুণগত মান ও দাম যাচাই করাই ছিল তার দায়িত্ব। মদিনাতে তার সাফল্য দেখে পরবর্তীতে তিনি মক্কাতেও একজন নারী মার্কেট ইন্সপেক্টার নিয়োগ করেন।

কর্মক্ষেত্রে নারীর সাফল্য কিন্তু অনেকটাই সহজাত। গবেষণায় দেখা গেছে, নারী কর্মীরা তাদের পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় বেশি মনোযোগী, সৎ, কর্মতৎপর ও সিরিয়াস। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, নারীদের ক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগ ফিরিয় দেয়ার হার ৫১%, পুরুষদের ক্ষেত্রে যা ৪২%!

বাংলার মাটি যাকে পেয়ে ধন্য

নারী দিবসে আবারো গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সকল সাহসী নারী যোদ্ধাদের যারা সমাজের নানা কুসংস্কার ও ভ্রান্ত প্রথার বেড়াজাল ছিন্নভিন্ন করে নারী শিক্ষা ও জাগরণের বার্তা বয়ে এনেছিলেন।

তাদেরই একজন এই বাংলার সন্তান বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।

১১৫ বছর আগের, সমাজে নারীদের জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো যখনো জ্বলে ওঠে নি, ‘সুলতানার স্বপ্নউপন্যাসে তরুণী রোকেয়া তুলে ধরলেন সমাজের বিপরীত চিত্রনারীরাও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

নারী জাগরণের লক্ষ্যে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলেন নারী শিক্ষা প্রসারের কাজে। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তার ছিল না। সম্পদ বলতে ছিল শুধু মনোবল ও সাহস।

কতটা দৃঢ়চেতা তিনি ছিলেন তা সহজেই বোঝা যায় সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলা তার এই বাণী থেকে, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া লইতে হইবে, যেন নিন্দা গ্লানি উপেক্ষা অপমান কিছুতেই তাহাকে আঘাত করিতে না পারে। মাথার খুলিকে এমন মজবুত করিয়া লইতে হইবে, যেন ঝড় ঝঞ্ঝা বজ্র বিদ্যুৎ সকলেই তাহাতে প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া আসে!’

শিক্ষিত জাতি নির্মাণে এই সাধারণ বাঙালি রমণীর প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত ছিল মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনসহ নাম না জানা সকল মহীয়সী নারীদের প্রতি আমরা অন্তরের গভীরতম প্রদেশ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার বদৌলতেই নারীজাতির আজকের স্বাধীনতা, আজকের সম্মান।