গ্রীষ্মকাল অনেকের কাছেই আকাঙ্খিত ঋতু। কারণ এই মৌসুমেই সবচেয়ে বেশী সুমিষ্ট ফল পাওয়া যায়। যে-কারণে গ্রীষ্মের মাসগুলোকে বলা হয় মধুমাস।
তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন এসেছে। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি থাকছে। কখনো কখনো তা এতটাই অসহনীয় হয়ে ওঠে যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়, অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাপমাত্রা যতটা না বেড়েছে, গরম অনুভূত হচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি। এর জন্যে বেশ কিছু বিষয় দায়ী।
বছরের এই সময় পৃথিবী বিষুব রেখায় সূর্য বরাবর অবস্থান করে। এতে সূর্যরশ্মি সরাসরি ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে।
এছাড়া, বনভূমি ও জলাভূমি কমে যাওয়া, বায়ুদূষণ, বাতাসে কার্বন মনো-অক্সাইড ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে যাওয়া, কলকারখানা ও যানবাহন বৃদ্ধি, বৃক্ষ নিধন, গ্রীনহাউস ইফেক্ট ইত্যাদি কারণে মার্চ মাস থেকেই গরমের তীব্রতা শুরু হয়। এপ্রিলে গরম হয়ে ওঠে মারাত্মক কষ্টদায়ক।
গ্রীষ্মে পানিশূন্যতা খুবই নৈমিত্তিক ঘটনা। শরীরে পানির স্বল্পতা হলে, অর্থাৎ পানির পরিমাণ অন্যান্য তরল পদার্থ থেকে কমে গেলে পানিশূন্যতা হয়। এর ফলে শরীরের ভারসম্যহীনতা, দুর্বলতা, মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, দৃষ্টি ঝাপসা ও চোখ-মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেতে পারে।
তীব্র গরমে শরীর থেকে ঘামের মাধ্যমে পানির সাথে বের হয়ে যায় সোডিয়াম ও পটাশিয়াম লবণ। এতে বিনষ্ট হয় ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য। ফলে হাত, পা ও পেটের পেশীতে খিঁচুনি হয়, পেশিতে টান ধরে এবং অসম্ভব যন্ত্রণা হয়।
হিট ক্র্যাম্প হচ্ছে হিট এক্সহশনের প্রথম ধাপ। শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে হিট এক্সহশন হয়। এতে মানুষ অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে।
বাইরের তাপমাত্রা যেমনই হোক না কেন, আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা প্রায় স্থির রাখতে সক্ষম। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। এই অবস্থাকে বলে হিট স্ট্রোক। এর ফলে ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়ালে হিট স্ট্রোক হতে পারে। এটি তাপ সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুতর অসুস্থতা এবং জীবনের জন্যে হুমকিস্বরূপ।
তীব্র গরমে যথাসম্ভব ঠান্ডা পরিবেশে থাকার চেষ্টা করুন। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দুপুরে বাইরে বের না হওয়াই ভালো। বাইরে গেলে অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করুন।
পাতলা ঢিলেঢালা পোশাক পড়ুন। সাদা বা হাল্কা রঙের আরামদায়ক কাপড় হলে ভালো। বাচ্চাদের জন্যে সুতির কাপড় ব্যবহার করুন।
এসময় পর্যাপ্ত পানি পান করুন। খাদ্য তালিকায় তরল খাবারের পরিমাণ বেশি রাখুন। বাইরে গেলে সাথে রাখুন পানির বোতল।
তবে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খাবেন না। এতে সর্দি-গর্মি হতে পারে।
প্রচুর পরিমাণে তাজা ফল খান। আম জাম লিচু তরমুজ বাঙ্গি শুধু আপনার রসনাকেই তৃপ্ত করবে না, গরমের বিরুদ্ধে দেবে সুরক্ষাও।
সম্ভব হলে নিয়মিত পান করুন ডাবের পানি, লেবুপানি, বেলের শরবত।
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখুন পর্যাপ্ত সবুজ সবজি ও সালাদ। এতে শরীরে পানি, লবণ ও খনিজের ঘাটতি পূরণ হবে, শরীর থাকবে ঠান্ডা।
গরমে সারাক্ষণ এসির মধ্যে থাকার প্রবণতা আছে অনেকেরই। এটা খুবই ক্ষতিকর। শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের এসির ঠান্ডায় শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের সমস্যা হতে পারে।
এসির মধ্যে থাকতে হলে তাপমাত্রা অতিরিক্ত শীতল করবেন না।
এছাড়া, ঘুমের সময় এসি বন্ধ রাখাই ভালো
সফট ড্রিঙ্কস হলো কার্বোনেটেড বেভারেজ। কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছাড়াও এতে থাকে ফসফরিক অ্যাসিড, ইথিলিন গ্লাইকল ও চিনি।
সফট ড্রিঙ্কস খেলে শরীরে প্রচুর ক্যালরি প্রবেশ করে। ফলে ঘন ঘন পানির পিপাসা লাগে, গলা শুকিয়ে আসে।
তাছাড়া সফট ড্রিঙ্কস শরীরের পানিকে নিরুদিত করে পানির স্বল্পতা তৈরী করে।
গরমে বাইরের খোলা খাবার, স্ট্রীটফুড, রাস্তার পাশের শরবত, বরফ দেয়া আখের রস ইত্যাদি খাবেন না। ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুড, ক্যানড ফুড পুরোপুরি বর্জন করুন। এড়িয়ে চলুন ভাজাপোড়া, গুরুপাক ও তেল-চর্বিযুক্ত খাবার।
গরমে এসব খাবার হজমে জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়াও গ্যাসের সমস্যা, বদহজম ও ডায়রিয়া হতে পারে।
গরমকালে অনেকেই বেশি বেশি খাবার স্যালাইন খান। বিশেষত যারা রোদে কাজ করেন। এই স্যালাইন খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ বেশি বেশি স্যালাইন খাওয়া শরীরের জন্যে মোটেই ভালো নয়।
আর স্যালাইন খেতে হলে অবশ্যই প্যাকেটের গায়ে লেখা নির্দেশনা মেনে খান।
নিয়ম হচ্ছে, প্যাকেটের সবটুকু গুঁড়া আধা লিটার পানিতে গোলাতে হবে। এর চেয়ে অল্প পানিতে মেশালে শরীরে লবণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে। এর প্রভাবে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, বিশেষ করে মস্তিষ্কের। একসময় কোষগুলো নষ্ট হবে। পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।