
published : ২৩ অক্টোবর ২০২৫
AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শুরু ১৯৪০-এর দশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনী একটি ‘অত্যাধুনিক’ যন্ত্রের সাহায্যে তাদের গোপন বার্তা লিখত ও পড়ত। এর নাম ছিল ‘এনিগমা’ (Enigma)। এটি একধরনের রোটর মেশিন, যা এনক্রিপশন (encryption) ও ডিক্রিপশনের (decryption) মাধ্যমে অক্ষরগুলোকে জটিলভাবে বদলে দিত।
১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ব্লেচলি পার্ক’ নামে এক গোপন জায়গায় নিজেদের সেরা মেধাবীদের একত্রিত করে। তারা অ্যালান ট্যুরিং-এর নেতৃত্বে ‘এনিগমা’ কোড ভাঙার জন্যে বিশেষ এক যন্ত্র তৈরি করে। এর নাম দেওয়া হয় ‘দ্য বম্ব’। যন্ত্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে জার্মানদের ‘এনিগমা’ কোড ভেঙ্গে সংকেতের ভেতর লুকানো বার্তা উদ্ধার করত।
এই আবিষ্কারে ঘুরে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড়। বলা হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সূচনা ছিল এটাই।
‘দ্য বম্ব’কে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলা হলেও এটা কিন্তু আজকের দিনের মত নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারত না। প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় বললে সে কাজ করত ‘কন্ডিশনাল লজিক’ অনুযায়ী। এই নির্দেশ নেয়ার উপায় হলো If বা ‘যদি’ এবং Else বা ‘না হয়’ ইত্যাদি কম্যান্ড।
যেমন ধরুন, আপনার বাসায় ‘স্মার্ট’ পানির কলে নির্দেশ দিয়ে দিলেন- ‘যদি’, গরমকাল হয়, তবে ঠান্ডা পানি সরবারহ করো। ‘না হয়’ (অর্থাৎ গরমকাল না হলে) মৃদু গরম পানি সরবরাহ করো। এর মধ্যে কম্পিউটারের চিন্তার কিছু নেই। যন্ত্রটি যদি সেন্সরের থেকে বাইরের তাপমাত্রা মাপতে পারে, তাহলে এটি সহজেই এই যুক্তি অনুযায়ী আপনাকে ঠান্ডা বা গরম পানি দিতে পারবে। ১৯৪০-এর দশকে এসে মানুষ এটাই কেবল বাস্তবায়ন করতে পেরেছে।
এর পরের ধাপে, ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত মানুষ ধীরে ধীরে যন্ত্রকে ‘শেখাতে’ শুরু করে। এই শেখানোকে বলা হয় ‘মেশিন লার্নিং’, বর্তমানে একেই বলা হয় ‘ডিপ লার্নিং’।
বিশ্বজুড়ে এআই (Artificial Intelligence) প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি মানুষকে মুগ্ধ করছে। চ্যাটবট কথা বলছে মানুষের মতো, ছবি আঁকছে শিল্পীর মতো; এমনকি চিকিৎসকের মতো পরামর্শও দিচ্ছে। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে থাকা প্রযুক্তিটা কি আদৌ বুদ্ধিমান?
কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিস্ট গিয়োম থিয়েরি (Guillaume Thierry) এ ব্যাপারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন: “AI বুদ্ধিমান নয়, আর আমাদের এই অপপ্রচার বন্ধ করা উচিত।”
থিয়েরির মতে, বর্তমানের AI সিস্টেমগুলো মূলত একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক যন্ত্র। তারা বিশাল পরিমাণ ডেটা থেকে প্যাটার্ন বের করে এবং তার ভিত্তিতে তৈরি করে উত্তর। এর মধ্যে কোনো ‘বোঝা’, ‘অনুভব’, বা ‘উদ্দেশ্য’ কাজ করে না।
অর্থাৎ, AI যতই মানুষের মতো কথা বলুক না কেন, তারা জানে না কী বলছে—অনুমান করছে শুধু।
আসলে এই AI গুলো দেখতে, শুনতে, এবং কথাবার্তায় এতটাই মানবসদৃশ যে মানুষ ভুল করে ধরে নেয় তারা সত্যিকারের বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন। এবং সেখান থেকেই শুরু হয় বিপত্তি।
থিয়েরির মতে, আসল হুমকি AI নয়, বরং যারা AI তৈরি করছে তাদের উদ্দেশ্য ও ব্যবহার পদ্ধতি। যখন ডিজাইনাররা AI-কে মানুষের মতো করে উপস্থাপন করেন—চোখ, মুখ, আবেগের প্রকাশ, এমনকি কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে, তখন সাধারণ ব্যবহারকারীরা আবেগগতভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। তারা AI-কে বন্ধু, সহকর্মী এমনকি উপদেষ্টা হিসেবেও গ্রহণ করতে শুরু করে।
সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিরাপত্তা যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো রিসার্চ এক গবেষণায় প্রমাণ পেয়েছে, চ্যাটজিপিটির নতুন মডেল OpenAI o1 শুধু মিথ্যেই বলে না, নিজেকে বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ‘লুকোচুরি’, এমনকি প্রতারণাও করতে পারে! গবেষণায় দেখা গেছে আত্মরক্ষায় মরিয়া চ্যাটজিপিটি এই কাজ করে এবং এর প্রমাণ লুকানোর পাশাপাশি ধরা পড়ে গেলে অস্বীকারও করে!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা গবেষণায় বড় অগ্রগতি মনে করা হচ্ছে এটিকে। পাশাপাশি শঙ্কা ও বিতর্কও উসকে দিয়েছে এ গবেষণা।
২০০৫ সাথে রে কার্জওয়েল আলোচনায় আসেন তার AI Singularity ধারণার জন্য। এই তত্ত্ব অনুসারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ছাড়িয়ে যাবে এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছাবে, যা আমাদের বর্তমান বোঝার ক্ষমতার বাইরে।
১৯৫০-এর দিকে গণিতবিদ জন ভন নিউম্যান প্রথম এই ধারণা দেন। কার্জওয়েল সিঙ্গুলারিটির ধারণাকে আরও জনপ্রিয় করেন তার ২০০৫ সালের বই ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ার’-এ এবং এর প্রায় ২০ বছর পর তিনি লেখেন বই ‘দ্য সিঙ্গুলারিটি ইজ নিয়ারার’।
তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ২০২৯ সালের মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব-সমতুল্য বুদ্ধিমত্তা অর্জন করবে; এবং ২০৪৫ সালের মধ্যে সিঙ্গুলারিটি ঘটবে। সেই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে অনেক গুণ ছাড়িয়ে যাবে এবং মানব ও যন্ত্রের মধ্যে একীভবন ঘটবে।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আমরা যে দিন দিন OpenAI বা ChatGPT, Gemini, Co-Pilot এদের উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছি— যদি যন্ত্র আমাদের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয় তাহলে আমাদের কর্মক্ষেত্র ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? গবেষকদের মতে, AI একদিকে যেমন প্রযুক্তির আশীর্বাদ, অন্যদিকে মানব সভ্যতার কর্মহীনতার ভয়ংকর সংকেতের পূর্বাভাস। AI-এর নির্মাতারাই এখন বলছেন, মানুষের কল্পনা শক্তি, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, শিল্প সত্তাকে পঙ্গু করার ফাঁদ বর্তমান জেনারেটভ AI!
থিয়েরি যে সমাধানটি প্রস্তাব করেন তা হলো, এআইকে শুধু একটি উপকরণ (tool) হিসেবে ব্যবহার ও উপস্থাপন করতে হবে। আপনিই হলেন ক্রিয়েটর। জেনারেটিভ AI-এর কাজ হল আপনার ক্রিয়েটিভ সত্ত্বাকে আরও উন্নত করা, আপনার হয়ে সমস্ত কাজ করে দেওয়া নয়।
শুরু করার জন্যে AI এর সাজেশনগুলি কাজে লাগান, তারপর একদম অরিজিনাল কোনো কন্টেন্ট তৈরি করতে আপনার নিজস্ব স্বতন্ত্র ভয়েস ও আইডিয়া যোগ করুন। তবে নির্মাণ ও প্রডাকশনে এর প্রয়োগ ও মাত্রাটা যত সীমিত রাখা যায় ততই ভালো। তাতে অন্তত আপনার কল্পনা শক্তি, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, শিল্প সত্তাটা জেগে থাকবে।
AI-কে যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবহার করতে পারলে তা হবে মানুষের অন্যতম বন্ধু। তাই Open AI-কে আমাদের বিকল্প হতে না দিয়ে চলুন নিজেদের দক্ষতা বিকাশ নিয়ে কাজ করে দক্ষ কর্মশক্তি তৈরির মাধ্যমে নিজেদের AI-এর বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করি। AI যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণ না নেয়; বরং আমাদের হাতেই তৈরি হোক এমন এক ভবিষ্যৎ, যেখানে যন্ত্র আর মানুষ মিলেই গড়ে উঠবে এক উন্নত মানব সভ্যতা।