published : ৩০ মে ২০১৩
ধরুন, ঘটক মানে বিয়ের ক্ষেত্রে সমন্বয়কের কাজটি যিনি করছেন তিনি এক পাত্রের সন্ধান নিয়ে এলেন। পাত্র কোথায় থাকে, কী করে এসব প্রশ্নের পর মেয়েপক্ষ জানতে চান, কার ছেলে বা কার নাতি। তো যেই ফেসবুক নিয়ে আজকের আলোচনা, যা আমাদের কাছে এই মুহূর্তে গবেষণা ও চুলচেরা বিশ্লেষণের জন্যে হাজির, সেই ফেসবুকের আদি পরিচয়টা আমরা একটু জানি। তারপরই আমরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় চলে আসব।
ফেসবুকের ডিজিটাল পরিচয় হচ্ছে এটা কম্পিউটারের নাতি বা নাতনী, মেয়ে না ছেলে আমরা জানি না। এর মা কিংবা বাবা হচ্ছে ইন্টারনেট। এটার কাজ মানুষকে সামাজিকভাবে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। কারণ, সমাজ বইতে ছোটবেলায় পড়েছেন না, মানুষ সামাজিক জীব। সমাজের বাইরে সে চলতে পারে না, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর ফেসবুকের জন্মের আগেই এটা নিয়ে যিনি মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন বা পায়ের ঘাম মাথায় তুলে এখন এসিরুমে আরাম করছেন সবার বারোটা বাজিয়ে, তিনি হচ্ছেন মার্ক জুকারবার্গ। ফেসবুক নামের যে বস্তুটির জন্ম হয়েছিল হার্ভার্ড ছাত্রদের যোগাযোগের জন্যে সেটি এখন পরিণত হয়েছে এক সর্বগ্রাসী সামাজিক দানবে।
বারটা বাজানো, সর্বগ্রাসী সামাজিক দানব বলছি বলে কিন্তু ভাববেন না তাকে আমরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। আসলে আমরা নই, পৃথিবীর যতখানে যত জ্ঞানী, প্রাজ্ঞ মানুষ আছেন, তারা বলছেন এর বিপক্ষে। কী বলছেন সেগুলো নিয়ে আমরা ধাপে ধাপে এবার একটু শুনি। আসলে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আরও অনেকগুলোই আছে, কিন্তু আমরা ফেসবুকের কথাই শুধু বলছি এজন্যে যে এটা অন্য সবগুলোর বাবা হয়ে গিয়েছে। বাকিদের কথা এটা থেকে সহজেই অনুমান করে নেয়া যাবে।
ফেসবুক–এটা ঠিক যে, বস্তু হিসেবে প্রযুক্তি হিসাবে এটি অনেক কাজের। যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে, শিক্ষার বাহন হিসেবে, কিংবা বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে চাইলেই এটার সম্ভাবনার দিকগুলোকে কোনোভাবে অস্বীকার করা যাবে না। পুরনো বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক বা সহকর্মীদের সাথে সহজে যোগাযোগ, খবরাখবর নেয়া, কী হলো না হলো, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে, কে কী বলছে—এসব জানতে পারা; কার বেবী হলো, ছেলে না মেয়ে, কে পাশ করল না করল থেকে শুরু করে এইমাত্র খেলাম, এখন বাথরুমে যাচ্ছি—এসব ছোটখাটো বিষয় পর্যন্ত শেয়ার করতে পারছি। কী দারুন না! মাঝেসাঝে মনে হয়, লেখাপড়ার প্রয়োজনে গ্রুপ ডিসকাশনসহ কত না উপকার করছে ফেসবুক!
কিন্তু ......এখানে একটা কিন্তু আছে। এতক্ষণ যা বললাম, সেটা তো গেল কিতাবি কথা। বাস্তবে কী হচ্ছে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিন নাই রাত নাই, খালি ফেসবুক আর ফেসবুক। যে ফেসবুকের পড়ায় সাহায্য করার কথা, সে-ই দেখা যাচ্ছে পরীক্ষায় লাড্ডু এনে দিচ্ছে। এতো পপুলার যে ফেসবুক! অনেকেই ব্যবহার করে, কেউ বাদ যায় না—এতো ভালোই যদি হবে, আজ পর্যন্ত এমন মা কি কেউ দেখাতে পারবেন, যিনি ছেলের ফেসবুক দেখে আঁতকে ওঠেন নি?
যে সামাজিক যোগাযোগে মানুষের কাছে আসবার কথা, সেই দেখা যাচ্ছে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীকে পর করে দিচ্ছে, দূরে ঠেলে দিচ্ছে। যার ফেসবুকে এত ফ্রেন্ড, সে-ই দেখা যায় পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সাঁঝবেলার মলিন আলোতে ঘরের কোণায় বসে ফেসবুকে লিখছে, আই এম এলোন ইন দা হোল ওয়ার্ল্ড!
কেন এই লোনলি জেনারেশন? কেন আজ সমাজ বিজ্ঞানীরা আমেরিকা ইউরোপে এটেনশন ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিজঅর্ডার বা এ ডি এইচ ডি-র আশঙ্কাজনক বেড়ে যাওয়া, আত্মহত্যা, সামাজিক অবক্ষয়, দাম্পত্য কলহ, ছাত্রছাত্রীদের বিষণ্ণতা, অপরাধ প্রবণতা, মাদকাসক্তি, ডিভোর্স—এসবের কারণ হিসেবে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর দিকে আঙুল তুলছেন? দোষটা কি ফেসবুক নামক প্রযুক্তির? নাকি আমাদের? যারা ব্যবহার করছি। ভেবে দেখা প্রয়োজন।
যারা ব্যবহার করছি তো করছিই। সময় কতোটুকু ব্যয় হলো, স্বাস্থ্য কতোটুকু হানি হলো সেটা দেখছি না-কেন? কেন এত অন্ধ হয়ে গেছি আমরা ফেসবুকের প্রেমে? কেনো আমরা ফেসবুককেই জীবন-মন-প্রাণ দিয়ে দিচ্ছি? কারণ, আমরা জানি না এটা কেন ব্যবহার করব, কতটুকু করব, ক্ষতিই বা কতটুকু? আমরা যদি জানতাম কীসে আমাদের আটকে রেখেছে, আর কতো ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তাহলে কখনই এরকম করতাম না।
আসলে কী হচ্ছে? একটু দেখি।
এই যে ক্লিক করলাম। স্ট্যাটাস দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেক রিপ্লাই চলে এলো। একদম ইনস্ট্যান্ট, সাথে সাথে। ব্রেন সেটার সাথে কন্ডিশন্ড হতে থাকে। এই ইনস্ট্যান্ট একশন ও রি-একশনের জগতটা আমরা পছন্দ করতে শুরু করি। আকর্ষণ থেকে ভালবাসা; মোহ চলে আসে। সে জগতে থাকতেই ভালো লাগে। সেখানকার ব্যাপার স্যাপারেই আসক্ত হয়ে যাই।
কিন্তু বাস্তবতা কি এরকম ইনস্ট্যান্ট? বাস্তবে মন খারাপ হলে কি সবসময় সাথে সাথে একজন বন্ধু পাবেন যে পাশে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনার দুঃখের গীত শুনে যাবে আর আহা উহু করবে? কখনোই না।
তো যেটা ঘটছে, তা হলো আমরা প্রত্যাশা করছি ভার্চুয়াল জগতের সবকিছু বাস্তবেও ঘটবে। এমনকি আপনি পারলে বাস্তব জগৎ থেকে ভ্যানিশ হয়ে ভার্চুয়ালে চলে গেলেই বাঁচি এরকম প্রত্যাশা পুষে রাখছেন মনে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেটা কখনো সম্ভব নয়। বাস্তব জগতের ঝক্কিগুলোর মুখোমুখি আমাদেরকে হতেই হবে।
বাস্তব জগতের সামনাসামনি কথোপকথনে অনেক শারীরিক, মানসিক, রাসায়নিক ব্যাপার কাজ করে। অনেক কায়দা করে কথা বলতে হয়। অনেক বুঝে চলতে হয়। ফেসবুকে যেমন অনেক ভেবেচিন্তে, ইন্টারনেট সার্চ দিয়ে মাইন্ড ব্লোইং, সেইরকম স্মার্ট কমেন্ট করে যাচ্ছেন, বাস্তবে মুহূর্তে সেরকম স্মার্ট হতে পারছেন না।
বাস্তবে কিন্তু ফেসবুকের আপনি’র মতে অত জনপ্রিয় নন, তত ফ্রেন্ডও নেই আপনার, আপনাকে অত গুরুত্বও দেবে না সবাই। এটাই বাস্তব। কিন্তু আপনার মানসিক অবস্থাকে আপনি এমন অবস্থায় নিয়ে গেছেন যে বাস্তব ফেস করার জন্যে কোনো প্রস্তুতিই আপনার নেই। পদে পদে হতাশা। জীবনের প্রতি ভীতিশ্রদ্ধ। একসময় আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেয়া।
ভেবে দেখুন, আজ আমরা নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতে কত সাহস হারা হয়ে যাই। আমরা কি সচেতনভাবে নিজেকে বাস্তব জগতের জন্যে অযোগ্য অথর্ব হয়ে যাওয়া সমর্থন করতে পারি কখনও? কখনো না।
সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার হলো এই অযোগ্যতার হতাশা কাটাতে আমরা বার বার ফিরে যাচ্ছি সেই একই জায়গায় ফেসবুকে। এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারি না। আসক্ত হয়ে যাই। মাদকাসক্ত যেমন মরবে জেনেও মাদক ছাড়তে পারে না। আরও আঁকড়ে ধরে, আমরাও তখন ঐ জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারি না। আরও ঢুকে যাই। উদ্দেশ্যহীন পরিণতির দিকে যেতে থাকি।
আপনি তো বলবেন, আমি এমন কী আর ইউজ করি। একটু বসি। একটু মাঝে মাঝে প্রোফাইল চেক করি এই আর কি! কিন্তু ভায়া, ফেসবুকের আসক্তি এই একটু একটু করেই হয়।
ফেসবুক এত ইন্টারএকটিভ করে ডিজাইন করা যে, ভালো লাগবেই। এখানে গ্যাজাতেই ভালো লাগবে। কে কী করল তা দেখলেন, একটু লাইক দিলেন, শেয়ার করলেন কিছু। সময় কতটুকু গেল একটু যদি অনেস্টলি হিসেব করেন, বেশি না মাত্র এক সপ্তাহ হিসাব করেন যে কতক্ষণ ফালতু গ্যাজালাম। আপনি বুদ্ধিমান হলে তখনই ফেসবুকের সাথে বিচ্ছেদে যাবেন।
আর যদি বুদ্ধিমত্তার একটু ঘাটতি থাকে, তাহলে, জেনে রাখুন, আপনার 'লাইক' ‘শেয়ার’, সবকিছুই কিন্তু রেকর্ড করা হয়। আপনার যত কনটেন্ট সব যে ডাটা ব্রোকারদের কাছে সেল হয়, সে খবর কি জানেন? এখন এমনও সফটওয়্যার রয়েছে, আপনি কী রকম, কী পছন্দ-অপছন্দ, কোথায় খান, কোথায় ঘুমান, বেড়াতে যান—শুধু তাই নয়, এরপর কোথায় যেতে পারেন সেটাও নাকি বেশ ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারে।
স্পিলবার্গ এর মাইনোরিটি রিপোর্ট দেখে থাকলে বুঝতে সহজ হবে। সেখানে কী হয়? পুলিশ এমন একটি সফটওয়্যার তৈরি করে যেটা অপরাধ হবার আগেই অপরাধীকে ধরে ফেলতে পারে, তার প্রোফাইল প্রেডিক্ট করে। একবার ভাবুন, একজন নিরীহ লোক শুধু এই সফটওয়্যার এর প্রেডিকশন এর কারণে খুন না করেও হাজতে চলে যেতে পারে। এটা এখন ফিকশন নয়, বাস্তব। নিকট ভবিষ্যতেই এটার প্রয়োগ হতে পারে। এটাতো একটা দিক মাত্র।
আরও কতভাবে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য এক্সপোজড হতে পারে! আর এই সফটওয়্যারগুলোর ডাটা কোত্থেকে আসবে? এই যে আপনার যত একটিভিটি অনলাইনে, ফেসবুকে, যত লাইক, শেয়ার, স্ট্যাটাস আপডেট আর ছবি! আপনিই তো আপনাকে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন।
ভবিষ্যত ভাবনাই জ্ঞানীর কাজ, জ্ঞানী হোন। ফেসবুক বাদ দিন। সফলতার পথে অগ্রসর হোন। একজন সফল মানুষ বারাক ওবামা। তিনি ফেসবুক সম্পর্কে বলেন ‘আমাদের পরিচিত নয় এমন অনেক মানুষকে আমাদের বিষয় জানানোর প্রয়োজন কি?’ তার মতে ‘এর কোনো মানেই হয় না।’
তাই তো, আমি কি করছি না করছি দুনিয়াশুদ্ধ লোক কে জানাবার কোনো মানে হয়? আমি যখন ওবামার মতো সফল হবো, পেপারের লোক যখন-তখন চলে আসবেন আমার খবর ছাপবার জন্যে। তখন দুনিয়াশুদ্ধ লোক এমনিতেই জানবে।
আর এই যে নিজের সম্পর্কে জানানোর একটা গোপন ইচ্ছা। ‘আমি’ টাকে প্রকাশ করতে চাওয়া। এক ধরনের আত্মতৃপ্তি, আত্মপূজা—এটাও আপনার সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে।
গ্রীক পুরানের সেই বিখ্যাত চরিত্র নার্সিসাসের কথা শুনেছেন তো। তিনি তার সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত ছিলেন। একদিন স্বচ্ছ পানিতে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখলেন। ‘এত সুন্দর আমি!’ তাকিয়েই থাকেন, চোখ ফেরাতে পারেন না। স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকেন শুধু এবং তাকিয়ে থাকতে থাকতে শেষে মৃত্যুই হলো তার।
তো এই নার্সিসাসের লক্ষণ দেখা যায় ফেসবুক আক্রান্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। নিজের একটা অন্য সত্তা, একটা অন্য ‘আমি’ তৈরি করেন তারা ভাচুর্য়াল জগতে। অনেক পারফেক্ট, অনেক স্মার্ট অনেক সুন্দর সেই ’আমি’। সেই ‘আমি’-কেই ভালবাসতে থাকেন তারা, বাস্তবের ’আমি’ হয়ে যায় ঘৃণার, অবহেলার পাত্র। এটা তাদের মানসিক অসুস্থতার জন্ম দেয়।
ফেসবুকে আমরা কী করছি? এখানে কি আমার সত্যিকারের প্রোফাইল প্রতিফলিত হচ্ছে? অনেকেই এখানে নিজেকে সাজিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যা সবসময় শতভাগ সত্যি নয়। আমরা যেমন নিজেদের আসল পরিচয় ঢেকে রেখেছি ফেসবুকে, যাদের সাথে ফেসবুকে ফ্রেন্ডশিপ করছি তারাও কি বেশিরভাগ ফেক নয়? তাদেরকে কী ধরনের বন্ধু বলবেন আপনি?
ফেসবুক/ ইন্টারনেট যত ভালোই বলি, বাস্তবে যে এটা পড়ালেখা নষ্ট করছে, ক্রিয়েটিভ টাইমগুলো খেয়ে ফেলছে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারব না। আসলে দোষ তো ফেসবুক বা প্রযুক্তির নয়, দোষ আমরা অপরিমিত ব্যবহার করছি এটা। তো পরিমিত ব্যবহার করলেই হয়।
কিন্তু ফেসবুক হলো এমন জিনিস যে পরিমিত করতে চাইলেই করা যায় না। এটা এখন এত দূষিত হয়ে গেছে যে এটা থেকে ভালোর চাইতে খারাপই হচ্ছে বেশি। এই ব্যাপারটাই একটু বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখতে হবে যে, আমার কত আনা লাভ আছে এতে। আসলে কতটুকু সময় ব্যয় করে কতটুকু লাভ পাচ্ছি আমি।
বন্ধুদের সাথে যোগাযোগে? আসলে সত্যিকারভাবে বলুন তো, বড়জোর ৫/১০ জন ছাড়া আর ক’জনের কোন খবরটা ভালোভাবে জানেন আপনি। ক’জনের সাথে সম্পর্ক ভালো ও গভীর হয়েছে যেটা আপনার আসলেই কাজে লাগছে? ভালো করে দেখলে দেখবেন যে এই যোগাযোগ আপনি ফেসবুক ছাড়া আরো ভালো, আরো আন্তরিকভাবে করতে পারতেন।
আর পড়াশোনা বা তথ্য খোঁজা? সেটার জন্যে ফেসবুকের কোনো দরকারই নেই আসলে। আপনি বলবেন, কখনো ইমারজেন্সি গ্রুপ রিপোর্ট করতে গেল ডিসকাশনে সুবিধা হয়। আচ্ছা, আপনার ইমারজেন্সি কি প্রতিদিন থাকে? প্রতিদিন ফেসবুকে বসে সময় নষ্ট না করলে ঐ ইমারজেন্সি সিচুয়েশন কি আসত যে, হাতে একদিন সময়, অথচ রিপোর্টের কিছুই হয় নি।
আসলে ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নহে। ফেসবুকের ভালোটা এখন খারাপের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। খারাপ হতে হতে ওটা সংক্রামক ঘা-তে পরিণত হয়েছে। আপনিও সংক্রমিত হচ্ছেন। এখনই সতর্ক হোন। ফেসবুক বাদ দিয়ে অন্য রাস্তা দেখুন।
ফেসবুকে ঠোকাঠুকি না করে ঐ সময় বই পড়ুন, একটু বেড়িয়ে আসুন, পরিবারকে সময় দিন, পিয়ানো শিখুন বা নতুন ভাষা শিখুন। শুধু শুধু কেন খামোখা আরেকজনের ছবিতে লাইক আর কমেন্ট করে বা অন্যের হাবিজাবি মন্তব্য পড়ে সময় নষ্ট, স্বাস্থ্য নষ্ট করবেন?
অনেক তো করেছেন, এবার একটু থামা যায় না? একটু থামুন। ভাবুন আসলে কী করছেন আপনি? ভালো করছেন, না খারাপ করছেন? আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যে, আমরা ভাবছি। যেখানে ফেসবুকের একাউন্ট না থাকাটাকে তথাকথিত আধুনিক তরুণ-তরুণীরা রীতিমতো মূর্খতার সাথেও তুলনা করেন। সেখানে আমরা ফেসবুকের ব্যাপারে বেশ সচেতন হয়েছি। একাউন্ট ডিলিট করে দিচ্ছি। বাধ্য না হলে যেমন, টিচার নোটিশ দিচ্ছেন পরীক্ষার বা ভাইভার বা ক্লাসের। এরকম ক্ষেত্রে সেটা জানা ছাড়া আমরা বসে থাকছি না। আসলে সময় আমাদের। জীবনও আমাদের। এই জীবনের সময়কে কাজে লাগিয়ে সার্থক করে তোলার দায়িত্বও আমাদের। তাই আমরা যা কিছুই করি না কেন, সেটা থেকে নিজের ও মানবতার কল্যাণ কতটুকু হতে পারে এ প্রশ্ন করে যেন কাজে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
কারণ আমরা দেখছি যে, আমরা মানুষরা, সামাজিক জীব। সমাজ নিয়ে থাকতে পছন্দ করি। নিজেকে একঘরে করে রাখতে পছন্দ করি না। তো একঘরে না করে বহুঘরে করে রাখার জন্যে একটা সময় আমরা যে মহল্লায় থাকতাম বা যে রোডে থাকতাম, সেই রোডের প্রতিটি বাসায় কে থাকতেন, তারা কী করতেন, নিজেদের বয়সী কেউ আছে কি না তার খোঁজখবর রাখতাম। মায়েরা মায়েদের সাথে, বাবারা বাবাদের সাথে, ছোট/ বড় ছেলেমেয়েরা সমবয়সী খুঁজে বের করে তাদের সাথে দোস্তী করত। খেলার সাথী বানাত। যোগাযোগ তখন ছিল লাইভ, মানে বাস্তবে চোখে দেখার মধ্যে সীমিত। তখন খুব কম মানুষের বাসায় ল্যান্ড ফোন ছিল। তারপর এল টিভি, মানুষ ঘরবন্দি হলেন। এল মোবাইল, বাস্তবে জ্যাম ঠেলে, রিকশা ভাড়া খরচ করে না গিয়ে এবং না যাওয়ার কারণে মেজবানের আপ্যায়ন খরচ বাঁচিয়ে দিতে পেরে আমরা মনে করলাম যে, খুব ভালো কাজ হয়েছে। আসলেই ভালো হয়েছে, খুব জরুরি অবস্থার জন্যে। কিন্তু সত্যি বলতে যতটা না উপকার হয়েছে, তার চেয়ে বেশি অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। মোবাইল যে কীরকম বোমা সেটা নিয়ে পরে কোনো প্রোগ্রামে আমরা আলাপ করব।
আমরা যেখানে বলছিলাম, যোগাযোগ। এটা নিঃসন্দেহে একটি প্রয়োজনীয় কাজ। সামাজিক যোগাযোগ আরো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ইন্টারনেট নির্ভর যে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে, আমরা দেখছি যে, এগুলো আমরা যে সুস্থ যোগাযোগ করতে চাইছি সেটার সুযোগ, সম্ভাবনা নষ্ট করছে। আমরা হাসিখুশি হওয়ার বদলে বিষণ্ণ হচ্ছি। বহুঘরে হওয়ার বদলে একঘরে হচ্ছি। আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছি। পাশের বাসায় কে আছেন, জানি না। পাশের বিল্ডিংয়ে যখন লাশের পাশে বসে অন্যরা কাঁদছে, তখন এই বিল্ডিংয়ে ধুমধাড়ক্কা গান বাজছে। এটা তো গেল একটা দিক।
সবচেয়ে মারাত্মক হচ্ছে, ফেসবুকে তো কেউ আমরা বাস্তবে, সশরীরে থাকি না এবং সেখানে কেউ যেহেতু আমাকে বাস্তবে দেখছে না, তার মানে সেখানে আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। হারানোর কিছু নেই। তাই, যা ইচ্ছা করে তাই করতে নেই মানা। এই সুযোগ ফেসবুক থেকে শুরু করে যত নামে যত ধরনের সামাজিক যোগাযোগ সাইট আছে, সবখানে। কারণ, অন্যায় কিছু করলেও সেখানে কোনো বিচার নাই, জবাবদিহিতা নাই। অথচ সেই অন্যায়টা মানুষের চোখের সামনে করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি আছে, শাস্তি না হলেও লোকলজ্জা তো আছে। এই লোকলজ্জা আর মানুষের কাছে জবাবদিহিতা যে ‘এটা কী করলেন আপনি’ এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই আসলে নিজের ভুল করার সুযোগ অনেক কমে যায়।
আমাদের একটা অটোসাজেশন আছে না, ‘যখন কেউ আমাকে দেখছে না, তখন আমি যে কাজ করি তার মধ্যেই আমার আসল চরিত্র প্রকাশ পায়। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি নিজেই নিজেকে পর্যবেক্ষণ করব’। অন্য কেউই দেখছে না, কিন্তু আমি তো আমাকে দেখছি, আর অবশ্যই আল্লাহ দেখছেন। এই অনুভূতি আনতে পারলে ভুল করার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। আর সেই সম্ভাবনা একেবারে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসে যখন, অন্যরা আমাকে দেখছেন, নজরে রাখছেন। এটা আমরা বুঝতে পারি এবং বুঝতে পেরে সেইভাবে কী, কীভাবে করতে হবে ঠিক করি। আর আমরা কোয়ান্টামে যারা আছি তারা কিন্তু সহজেই নজরে পড়ি। কারণ, সাধারণ মানুষ আমাদেরকে ঠিক তাদের মতো মনে করেন না। মনে করেন, আমরা তাদের থেকে একটু হলেও আলাদা। এই আলাদা মানে হচ্ছে আমরা একটু বেশি প্রশান্ত, আমরা সহজেই রাগি না, গন্ডগোলের মধ্যেও মাথা ঠান্ডা রাখি, আশার কথা বলি। আমাদের কাছে এলে তাদের ভালো লাগে, তারা বিশ্বাস করে মন খুলে অন্তত দুটো কথা বলতে পারেন। যে কারণে আমরা কোনো ভালো কিছু করলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশংসা আসে। আবার প্রশ্নবিদ্ধ কিছু করলেও রেহাই হয় না। খবর চলে আসে।
ঘটনা : চট্টগ্রামে গুরুজীর বিস্কুট কেনার ঘটনা।
[চিটাগংয়ে হলো যে আমি কোর্স শেষ করে, আমি তো সাধারণত বিস্কিট খাই এনার্জি প্লাস, বহুদিন ধরে। ওটার জন্যে দোকানে ঢুকেছি, আমি অফিসে আসার আগেই খবর হয়ে গেছে যে, গুরুজীকে ফাস্ট ফুডের দোকানে দেখা গেছে। ওখানে ফাস্ট ফুডও বিক্রি হয়, বিস্কিটও বিক্রি হয়। এখন চিন্তা করেন। আমি কিনলাম বিস্কিট, আর রিপোর্ট হলো ফাস্ট ফুডের দোকানে দেখা গেছে। ভুলও না, ফাস্ট ফুডের দোকানে দেখা গেছে। ফাস্ট ফুড কিনেছি এটাও বলে নাই, খেয়েছি এটাও বলে নাই, দোকানে দেখা গেছে। আসলে কী অবস্থা, আমি ইচ্ছা করলেও আমি যা কিছু করতে পারব না।]
আপনাদের শুনলে ভালো লাগবে যে, আমাদের যে ৪০ ঘরে যোগাযোগের পদক্ষেপ-এর মূল উদ্দেশ্য এটিই। নিজেকে ভালো করে গড়ে তোলা। চারপাশের ৪০ ঘর মানে সেটা প্রতিবেশী হতে পারেন, ক্লাসের সহপাঠী হতে পারেন, অফিসের সহকর্মীও হতে পারেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব তো আছেনই।
আপনি যখন সত্যের কথা বলবেন আপনার চারপাশে, আপনার তো একটা পরিচিত হয়ে যাবে এ কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট, কোয়ান্টিয়ার। আপনি তখন ইচ্ছে করলেই কি আর গালিগালাজ করতে পারবেন, রিকশাওয়ালার সাথে ঝগড়া করতে পারবেন, করলেই তো মুশকিল। কারণ সবাই জানে যে, কোয়ান্টাম গ্রাজুয়েট মানে ঠান্ডা মানুষ, ঝগড়া-টগড়া করে না। আপনি তখন ইচ্ছা করলেও ঝগড়া করতে পারবেন না। অর্থাৎ এই যে আপনি চারপাশে সত্যের আলো পৌঁছে দিচ্ছেন, আপনি কী করছেন, আপনার নিজের একটা সেইভ গার্ড আপনি করে ফেলছেন।
৪০ ঘরে যোগাযোগের মূল উদ্দেশ্য একদিকে যেমন প্রতিবেশীর হক আদায়, তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক রাখা, হাসিমুখে কথা বলা, তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। অন্যদিকে নিজে ভালো থাকার জন্যে তাদেরকেও ভালোর পথে আহ্বান করা। আর এই আহ্বান তখনই সুন্দরভাবে করা যাবে যখন আগে নিজের ক্ষেত্রে ভালো কথাগুলো মানা হবে। যে কারণে এ বছর এপ্রিলে প্রকাশিত আমাদের প্রত্যয়ন সিডির নাম হচ্ছে–‘আপনি বদলালে পৃথিবী বদলে যাবে’।
আমরা সবাই মিলে পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে চাই। বাংলাদেশী হিসেবে কল্যাণের পথে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চাই। এ চাওয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে সময় নষ্ট করে অর্থহীন কাজ করার কোনো মানে হয় না। কারণ, ২০২৫ আসতে আর মোটে ১২ বছর বাকি। আমরাই তখন প্রতিটি সেকশনে সেবকের অবস্থানে থাকব যদি আজকে থেকে আমরা নিজেদেরকে তৈরি করি।