published : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০
হিক্কিমোরি। একটি জাপানি পরিভাষা।
যারা ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘর থেকে বেরোয় না এবং মানুষ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে জাপানে তাদেরকে ‘হিক্কিমোরি’ বলা হয়।
খোদ জাপানি স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এই সংজ্ঞা দিয়েছে। এবং সরকারি তথ্যমতে ২০১০ সালে জাপানে এরকম হিক্কিমোরির সংখ্যা ছিল সাত লাখ।
গত ১০ বছরে এই সংখ্যাটা আরো বেড়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
সমাজে এর প্রভাবটা কী পড়েছে?
ঐতিহাসিকভাবে জাপান পৃথিবীর সবচেয়ে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ। গড়ে প্রতিদিন ৭০ জন মানুষ সেখানে আত্মহত্যা করে। (২০১৪ সালের হিসেব)
এদের মধ্যে বৃদ্ধরা যেমন আছে, ২০ থেকে ৪৪ বছর বয়সী পুরুষরা আছে। এমনকি আছে প্রাইমারি থেকে হাইস্কুল পড়ুয়া শিশুরাও।
অর্থনৈতিক উন্নতি, প্রযুক্তি আর বিলাসের এত আধিক্য সত্ত্বেও এই মানুষরা বেঁচে থাকার কোনো কারণকে আর খুঁজে পায় নি।
টোকিওর টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ওয়াতুরু নিশিদা বলেন, বিষণ্নতা এবং আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বিচ্ছিন্নতা বা একা থাকার প্রবণতা।
জাপানে একসময় বৃদ্ধ মা-বাবারা তাদের সন্তানের কাছে থাকতেন। কিন্তু এখন সেটা হয় না বললেই চলে।
অসুস্থ-বুড়ো মা-বাবাকে নিজের কাছে রাখার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম বা হাসপাতালে রাখতেই বেশি ইচ্ছুক জাপানিরা।
ফলে মা-বাবা যেমন একাকিত্বে আক্রান্ত হয়েছেন, তেমনি সন্তানও সুখী হয় নি।
বিশেষ করে নিজের শিশুবয়সী বা কিশোর বয়সী সন্তানের মানসিক টানাপোড়েনের সময় দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছ থেকে যে মানসিক সমর্থন তার সন্তানটি পেত, তা থেকে বঞ্চিত হয়ে শিশুটি হয়তো নিয়ে নিচ্ছে জীবনের চরম কোনো সিদ্ধান্ত।
২০১৭ সালে জাপানে আড়াইশ’র বেশি শিশু আত্মহত্যা করে যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অন্যদিকে গবেষণা বলছে, শিশু-কিশোর বা তরুণ তরুণীর মধ্যে মানসিক অসুস্থতা বা উদ্বিগ্নতা দেখা দিলে সেটা কাটিয়ে উঠতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে তার দাদা-দাদী বা নানা-নানী।
টেলিফোনে শিশু-কিশোরদের মানসিক সহায়তা দেয় এমন একটি হেল্পলাইন সংস্থা বলছে- দুই বছরে তারা ২১ হাজারেরও বেশি শিশু-কিশোরের সাথে কথা বলেছে।
ফোনেই তাদের সাথে কথা বলা হয়। খোলামেলাভাবে তাদেরকে কথা বলতে দেয়া হয়। আর এর মাধ্যমে অনেককে আত্মহত্যা থেকেও ফিরিয়ে আনা গেছে।
সংস্থাটি বলছে একজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে স্রেফ মন খুলে কথা বলাই যদি এত সহায়ক হয়, তাহলে মানুষটি যদি পরিবারের কাছের কেউ হন, তাহলে কী হতে পারে!
আর মা-বাবার ব্যস্ততার বাস্তবতায় দাদা-দাদী বা নানা-নানী হয়তো এ অভাব পূরণ করতে পারতেন খুব সহজেই- বলছে তারা।
আসলে আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবারগুলো ভেঙে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে ক’টি জিনিস, শিশুর সুস্থ বেড়ে ওঠা তার একটি।
যে কারণে ফ্রান্সের মতো কিছু দেশে এখন রীতিমতো আইন করে শিশুর পিতামহ এবং মাতামহের সাথে দেখা করার বিধান হয়েছে।
অবশ্য প্রাচ্যে এখনো যৌথ পরিবার ব্যবস্থা টিকে আছে। এবং আমাদের মা-বাবারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনো তাদের সন্তান-নাতি-নাতনীদের সাথেই থাকেন।
তবে অনলাইন আসক্তি, সমাজ বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি কারণে আমাদের এখানেও এখন এই নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব এবং তার পরিণতিতে আত্মহত্যার মতো চরম প্রবণতা বাড়ছে দিনকে দিন।
১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, আমাদের দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এর মধ্যে নারী-পুরুষ-শিশু সব বয়সের মানুষই রয়েছে।
আর এই বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্বের চরম রূপ আমরা দেখলাম এবার করোনাকালে। আতঙ্কবাদীরা এমনভাবে আতঙ্ক প্রচার করল, যাতে এমনকি পরিবার পরিজনকেও আমরা দূরে ঠেলে দিতে বাধ্য হই।
খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রচারিত বিজ্ঞাপনে লেখা হলো-সেভ হিউম্যানকাইন্ড বাই রিয়েলি রিয়েলি নট গেটিং নিয়ার ইট। সাথে নিঃসঙ্গ একটি শিশুর ছবি!
তাহলে প্রতিকার কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন কয়েকটি প্রতিকারের কথা-
বাস্তব যোগাযোগ বাড়াতে হবে। আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশী-প্রিয়জনদের সাথে নিয়মিত দেখা করতে হবে, কথা বলতে, তাদের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হবে। তাদেরকেও আপনার বাড়িতে আসতে বলতে হবে।
মনে রাখবেন সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের খবর রাখছেন বা ভিডিও কলে আত্মীয়দের সাথে কথা বলছেন-এটা বাস্তব যোগাযোগ নয়।
সন্তানদের সঙ্গে একাত্মতা বাড়াতে হবে। আসলে ‘কন্ট্যাক্ট’ আর ‘কানেকশন’- যোগাযোগ আর একাত্মতা এক নয়। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের চমৎকার একটি ঘটনা আছে।
বাংলার কৃতি সাধক স্বামী বিবেকানন্দ এখন থেকে সোয়াশ’ বছর আগে নিউইয়র্কে যখন ভ্রমণ করছিলেন তখন একজন সাংবাদিক তার কাছে এলেন।
স্বামীজী খুব চমৎকার ইংরেজি বলতেন। তার এক বক্তৃতার উদ্ধৃতি দিয়ে সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন-
আপনি বলছিলেন, কন্টাক্ট এবং কানেকশন.. আমি দ্বিধায় আছি। একটু যদি ব্যাখ্যা করেন!
স্বামীজী হাসলেন। আপাতদৃষ্টিতে নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললেন, আপনি নিউইয়র্কে থাকেন? বাড়িতে কে কে আছেন?
সাংবাদিক ভাবলেন, তিনি প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন। তাই এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন। তবুও বিরক্তি চেপে রেখে সাংবাদিক বললেন, মা মারা গেছেন। বাবা আছেন। আর তিন ভাই ও এক বোন। সবাই বিবাহিত।
স্বামীজী মৃদু হেসে বললেন, বাবার সাথে শেষ কবে কথা হয়েছে? বিরক্তি চেপে সাংবাদিক বললেন, মাসখানেক হবে।
স্বামীজী জিজ্ঞেস করলেন, ভাইবোনের সাথে দেখা হয়? শেষ কবে ফ্যামিলি গেট টুগেদার হয়েছে?
সাংবাদিক অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, দু’বছর আগে ক্রিসমাসের সময়। সবাই দুদিন একসাথে কাটিয়েছি।
স্বামীজী জিজ্ঞেস করলেন, বাবার পাশে বসে ছিলেন কতক্ষণ? আপনারা কি একসাথে ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার করেছিলেন? মা মারা যাবার পর আপনার বাবা কীভাবে সময় কাটাচ্ছেন জিজ্ঞেস করেছিলেন?
এবার সাংবাদিকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল।
স্বামীজী এবার তার হাত ধরে বললেন, আমি দুঃখিত আপনাকে অজান্তে আঘাত দিয়ে থাকলে। আসলে এটাই আপনার প্রশ্নের উত্তর!
বাবার সাথে আপনার কন্টাক্ট মানে যোগাযোগ আছে। কিন্তু কানেকশন নাই। একাত্মতা নাই।
কানেকশন একাত্মতা সংযুক্তি- এটা হৃদয়ে হৃদয়ে হয়, একসাথে বসা, খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, একে অপরের খেয়াল রাখা, স্পর্শ করা, একসাথে সময় কাটানো।
আপনাদের সব ভাইবোনের মাঝে যোগাযোগ আছে। কিন্তু কানেকশন নাই, একাত্মতা নাই। সংযুক্তি নাই।
সাংবাদিক চোখ মুছে বললেন, আপনার এই অবিস্মরণীয় শিক্ষার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।
তো আপনার সন্তানের সঙ্গে এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে থেকেও তার সাথে আপনার কানেকশন মানে একাত্মতা নাও থাকতে পারে।
তাই সন্তানের সাথে মিশে যান। বন্ধুর মতো তার সমস্যা, কষ্ট, সংকটগুলো বুঝতে চেষ্টা করুন। দেখবেন অনেক জটিলতা কেটে গেছে।
সারাক্ষণ পড়াশোনার কথা না বলে খেলাধুলা, সৃজনশীল হাতের কাজ, অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশা- ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
সন্তানকে চাপ মোকাবেলা করতে শেখাতে হবে। ব্যর্থতা মেনে নেয়া নিজেরাও শিখতে হবে, সন্তানকেও শেখাতে হবে। ব্যর্থতা জীবনের অংশ এটা বোঝাতে হবে।
নিয়মিত মেডিটেশন করতে হবে এবং সন্তানকেও মেডিটেশন শেখাতে হবে। জীবনের প্রতি ইতিবাচকতা, কৃতজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাস তাতে অনেক বেড়ে যাবে।
সৎসঙ্ঘে একাত্ম হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।
মানুষের জন্যে সেবাকাজ, কল্যাণ কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্যে যে তৃপ্তি ও আনন্দ আছে তা বিষণ্নতাকে ভাসিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।