করোনাকালে কোরবানি – অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ

নবম শতকের এক হজ মৌসুম। উটের কাফেলায় চড়ে হজে রওনা হয়েছেন বিখ্যাত বুজুর্গ রাবি ইবনে সোলায়মান।

পথে বিশ্রামের জন্যে এক শহরের বাজারে থামলে দেখা পান এক নারীর।

ভাগাড়ে পড়ে থাকা মৃত একটি খচ্চরের দেহ থেকে ছুরি দিয়ে মাংস কাটছে নারী।

রাবি ইবনে সোলায়মান ভাবলেন, এ বোধ হয় এই মাংস বাজারে বিক্রি করবে।

পিছু নিলেন তার। পৌঁছালেন নারীর বাসস্থান জীর্ণ কুটিরে।

শুনলেন নারী তার কন্যাদের বলছেন, “আর চিন্তা নেই বাছারা। খাবার এসে গেছে। একটু পরেই তোমরা মাংস খাবে।“

শুনে ইবনে সোলায়মান আঁতকে উঠলেন। তার মানে মা তার সন্তানদের মৃত পশুর মাংস খাওয়াচ্ছে!

চিৎকার করে বলে উঠলেন, হে আল্লাহর বান্দারা! আল্লাহর ওয়াস্তে এ মাংস তোমরা খেও না। এ মাংস এক মৃত পশু থেকে নেওয়া!    

নারী তো ক্ষিপ্ত! এ কি করলেন আপনি? আজ চারদিন এ এতিম শিশুগুলো অন্নহীন! কত কষ্টে কিছু খাবার যোগাড় করলাম। আর আপনি তা নষ্ট করে দিলেন!

রাবি ইবনে সোলায়মান স্তম্ভিত! এত দারিদ্র্যও হতে পারে!

জিজ্ঞেস করলেন, সন্তানদের বাবা কোথায়?

নারী বললেন, স্বামী তো খুব নেককার মানুষ ছিলেন! সৎ ছিলেন। কিন্তু সঞ্চয় কিছু ছিল না!

আজ এক বছর হলো তিনি মারা গেছেন। সেই থেকে আমাদের দিন চলছে নিদারুণে অর্থকষ্টে!

রাবি ইবনে সোলায়মান সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন বাজারে। নিজের সঞ্চয় দিয়ে ধামা ভরে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এলেন। তাদের হাতে দিয়ে বললেন, এই নাও কিছু খাবার। কয়েকদিন এ দিয়ে চলবে।

আর এই হলো কিছু অর্থ। বলে হযরত সোলায়মান তার কাছে থাকা বাকি সমস্ত অর্থ দিয়ে দিলেন।

হজে আর তার যাওয়া হলো না। ফেরা হলো না নিজের দেশেও। রাহা খরচ যে নেই!

রাহা খরচ যোগাড়ের জন্যে ঐ শহরেই একটা কাজ জুটিয়ে থেকে গেলেন।   

এদিকে সহযাত্রীরা যখন হজশেষে ফেরত যাত্রায় আবারো কাফেলা থামাল, রাবি ইবনে সোলায়মান সবার কাছে দোয়া চাইতে লাগলেন। বললেন, তোমরা তো হজ করে এসেছ। আমার জন্যে দোয়া করো।

তারা বলতে লাগল, আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? হজে তো আপনি আমাদের সাথেই ছিলেন!

আরেকজন দৌড়ে এসে বলল, আরে এই তো, আপনি এখানে! কি যে হন্যে হয়ে খুঁজছি আপনাকে। তাওয়াফ শেষে আশরফির এই থলেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে সেই যে উধাও হলেন, আর তো আপনার দেখা নেই! থলে বইতে বইতে আমার তো হাত ব্যথা হয়ে গেছে।

সবকিছুই রাবি সোলায়মানের কাছে বিস্ময়কর ঠেকছে। থলে খুলে দেখেন ৬০০ স্বর্ণমুদ্রা!

রাতে স্বপ্নে শুনলেন ঐশীবাণী- তার দান প্রবণতায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তার রূপে এক ফেরেশতা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবার হজে যে তার হয়ে হজ করেছে।

এবং হজশেষে ৬০০ স্বর্ণমুদ্রার একটি থলেও দিয়েছেন তার সেই ৬০০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে, যা হতদরিদ্র পরিবারটিকে রাবি ইবনে সোলায়মান দিয়েছিলেন!

আসছে ঈদুল আজহা। ঈদ মানেই আনন্দ।

তবে এবারের ঈদ হয়তো অনেকের জন্যেই আনন্দময় হবে না। কারণ আমাদের মাঝে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের উপার্জন প্রায় থেমে গেছে এই লকডাউনে। অনেকেই বেতন আংশিক পাচ্ছেন বা একেবারেই পাচ্ছেন না। অনেকের ফ্যাক্টরি বন্ধ, কোম্পানি বন্ধ, কর্মীদের বেতন দিতে পারছেন না ঠিকমতো।

তার চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দিনে আনে দিন খায় সেই মানুষগুলোর, যাদের পেটে এক বেলা খাবার ঠিকমতো জুটছে কিনা সন্দেহ।

আরও আছে এমন অনেক পরিবার যাদের এক বা একাধিক সদস্য করোনায় আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে সামাজিক চাপের মুখে ঘরবন্দী হয়ে আছেন তারা। আক্রান্ত হবার ভয়ে প্রতিবেশী-পরিজন তাদের একরকম পরিত্যাগ করেছে!

খুশির ঈদ, ক্ষুধার্ত ঈদ

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের দাফন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতায় এমন বেশ কিছু ঘটনাচিত্র উঠে এসেছে এবং আসছে - উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা, করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ায় তালাবদ্ধ করে রাখা হয় তাকে। সেই ঘরেই তার মৃত্যু হয়।

সদ্য বাবা হারানো শোকাহত পরিবার, যাদের প্রতিবেশীরা ঘরবন্দী করে রেখেছিল পুরো পরিবারকে

এক শিশু, যে প্রতিবেশীদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছে বাবার লাশ দাফনের জন্যে। সাড়া তো কেউ দেয়ই নি। বরং সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে ছিল মৃতের পরিবারের সকলে, কেউ খোঁজও করে নি। এমনকি দাফন শেষ হবার পরও তাদের বাড়িতে কেউ খাবার পাঠায় নি। পরে স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে।

এবারের কোরবানির ঈদে, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা হয়তো পরিবারের সাথে ঈদের দিনটা ভালো কাটাবেন, দু চারটা ভালো রেঁধে খাবেন।

ওদিকে করোনার্তদের অনেকেই হয়তো থাকবেন না খেয়ে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হলেও পথে নামতে পারবে না চক্ষুলজ্জায়।

প্রতি বছর আমরা ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে কোরবানি দেই। কোরবানি অবশ্যই অন্যতম একটি পুণ্যের আমল।

কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এবারের কোরবানির ঈদ আমাদের সামনে আরো বেশি পুণ্য লাভ করার সুযোগ এনে দিয়েছে।

তার আগে কোরআনে কোরবানির তাৎপর্য ও নির্দেশনাগুলো একটু ফিরে দেখা যাক।

কোরআনে কোরবানি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে  

কোরবানি একটি আরবি শব্দ যা এসেছে আরবি ‘কোরবান’ শব্দ থেকে, যার আদি শব্দটি ছিল ‘কুরব’। মানে নৈকট্য বা nearness.

কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ। মানে আমরা আমাদের কিছু ত্যাগ বা কোরবান করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করতে চাই।

যেমন চেয়েছিলেন নবী হযরত ইব্রাহিম (আ)। এবং এই নৈকট্য লাভেই আমাদের আনন্দ, আমাদের ঈদ।

পবিত্র কোরআনে সূরা হজে বলা হয়েছে -

৩৪. আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আর (সবসময় যেন মনে রাখে) একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব তাঁর কাছেই পুরোপুরি সমর্পিত হও। 

৩৬. কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে (মাংস সংগ্রহ করে) তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।

অর্থাৎ কোরবানি আমাদের জন্যে ইবাদতের একটি অংশ। আমাদেরকে যে জীবনোপকরণ দেয়া হয়েছে, তা যেন আমরা আল্লাহর নাম নিয়ে কুরবান করি। এবং তা সবার মধ্যে বিলিয়ে দেই। 

কিন্তু যদি আমরা শুধু আমাদের জীবনোপকরণ থেকে একটা অংশ কোরবান করি তাতেই কি আমাদের কোরবানি হয়ে যাবে?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় এর পরের ৩৭ নাম্বার আয়াতে -

৩৭. (কিন্তু মনে রেখো) কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এই লক্ষ্যেই কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীন করে দেয়া হয়েছে। অতএব আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, সেজন্যে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো।

অর্থাৎ আমরা আমাদের জীবনোপকরণ থেকে যে বস্তু বা পশু আমরা কোরবান করি তা স্রষ্টার কাছে পৌঁছায় না। স্রষ্টার কাছে পৌঁছায় আমাদের নিয়ত, আমাদের স্রষ্টা সচেতনতা।

সূরা মায়েদায় একটি ঘটনার মাধ্যমে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে –

হাবিল ও কাবিলের কোরবানি

সূরা মায়েদায় উল্লেখিত আছে মানবজাতির প্রথম কোরবানির ঘটনা।

দুই ভাই হাবিল ও কাবিল। হাবিল ছিলেন মেষপালক ও কাবিল ছিলেন জমিদার।

দুইজনকে তাদের পিতা আদম (আ) বললেন কোরবানি দিতে। এরপর দুই ভাই তাদের জীবনোপকরণ থেকে কোরবানি দিলেন।

হাবিল যেহেতু মেষপালক ছিলেন, তিনি মেষ কোরবানি করলেন। কাবিল যেহেতু জমিদার ছিলেন, তিনি তার জমির ফসল কোরবানি দিলেন।

কিন্তু কাবিলের কোরবানি কবুল হলো না। এবং তখন প্রকাশ হলো যে আসলে কাবিলের মনে শুরু থেকেই ছিল হিংসা ও অহংকার।

২৭. হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করব। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন। (সূরা মায়েদা)

অর্থাৎ কোরবানি শুধু কবুল হয় স্রষ্টাসচেতনদের।

যদি আমরা শুধু আমাদের জীবনোপকরণের একটা অংশ দিয়ে হাট থেকে গরু কিনে জবাই করে কোরবানি হয়েছে ভেবে ফেলি, তবে তা ভুল হবে।

কারণ কোরবানি করা বস্তু এখানে মূল নয়। জীবনোপকরণ থেকে কোরবানি কাবিলও দিয়েছিলেন। কিন্তু তা কবুল হয় নি।

করোনা বাস্তবতায় কোরবানি

আসলে আমরা কেন কোরবানি দিচ্ছি, কীভাবে কোরবানি দিচ্ছি – এই সচেতনতাটা জরুরি।

যখন আমরা অন্তর থেকে অনুভব করব যে আমরা স্রষ্টাকে পাওয়ার জন্যে, তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যে আমাদের জীবনোপকরণের একটি অংশ কোরবানি দিচ্ছি, তখন আমরা কোরবানির মূলে ঢুকতে পারব এবং লাভ করব স্রষ্টার দয়া ও নৈকট্য।

ধরুন, প্রতিবারের মতো এবারো কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী আপনি আপনার জীবনোপকরণের একটি অংশ কোরবানির জন্যে নিয়ত করলেন। তা দিয়ে একটা বড় গরু কিনলেন। ঈদের দিন জবাই করলেন। অন্নহীন ১০টি পরিবারকে আপনি সেখান থেকে ২ কেজি করে মাংস বিলি করলেন।

কাজটা অবশ্যই ভালো হবে। কিন্তু করোনার এই সময়ে সেই পরিবারগুলো ২ কেজি মাংস কতদিন খেয়ে বাঁচতে পারবে?

লকডাউনে কর্মহীন থাকা দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর ঘরে হয়তো চাল-ডালও নেই। যদি চাল-ডাল-তেল কোনোমতে জোগাড় করা যায়ও, ২ কেজি মাংসে তারা কতদিন ক্ষুধা নিবারণ করবে?

আপনি বলতে পারেন যে তারা আরেক জায়গায় বিক্রি করবে। কিন্তু এই ২ কেজি মাংস বিক্রি করে কত টাকাই বা সে পাবে!

২ কেজির বদলে আপনি ৩ কেজি, ৫ কেজি মাংসই না হয় দিলেন। কিন্তু এতে কি অন্নহীনদের মুখে আপনি অন্ন তুলে দিতে পারলেন? 

কোরবানির অন্যতম আদেশ হচ্ছে অভাবীদেরকে অন্নদান

আমরা যদি কোরআনে কোরবানি সংক্রান্ত আয়াতগুলো দেখি, তাহলে দেখব- কোরবানি প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বার বারই বলেছেন অভাবী-দরিদ্রদের মাঝে তা বিতরণের কথা।

সূরা হজ -

২৭-২৮. অতএব (হে নবী!) মানুষের কাছে হজের ঘোষণা দাও। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে বা উটের পিঠে চড়ে। দূরদূরান্ত থেকে তারা এসে যেন কল্যাণময় স্থানগুলোতে উপস্থিত হতে পারে। আর তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু দিয়েছেন, তা থেকে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নামে জবাই করতে পারে। তা থেকে তোমরা খাও এবং অভাবী দরিদ্রদের খাওয়াও।

৩৬. কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক করেছেন। তোমাদের জন্যে এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় এদের জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর এরা যখন জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে (মাংস সংগ্রহ করে) তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা শুকরিয়া আদায় করো।

প্রতি ঈদেই আমরা কোরবানি দেই। ইনশাল্লাহ আগামী ঈদগুলোতেও আমরা কোরবানি দিব। কিন্তু পৃথিবীর এই সংকটময় পরিস্থিতিতে, যেখানে হজ পর্যন্ত হচ্ছে না (সৌদি আরবের বাইরে হজ যাত্রীদের জন্যে), সেখানে আমরা কি পারি না কোরবানির মাধ্যমে অন্নহীন অভুক্ত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে?

কোরবানির মাধ্যমে দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকার উপায়

আমরা জানি যে রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে যে পেট পুরে খায় সে মুসলমান নয়, সে বিশ্বাসী নয়।

তাই আমরা যদি নবীজীর আদর্শকে ধারণ করে এই সময়ের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে চিন্তা করি যে, করোনায় দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারগুলোর, অসহায় ক্ষুধার্ত পরিবারগুলোর কি এই সময়ে ২/৫ কেজি মাংস দরকার?

নাকি লকডাউনের সময়টা বেঁচে থাকতে পারার জন্যে কিছু অর্থ দরকার? ডাল-ভাত খেয়ে হলেও তাদের পরিবারকে কয়েকটা দিন খাওয়ানোর মতো অর্থ দরকার?

আমাদের বিবেকই আমাদের কাছে উত্তরটা পরিষ্কার করে দেবে।

ধরুন অন্য সময় হলে আপনি একটা গরু বা ৭ নাম দিতেন। এর বদলে আপনি এবার ৫ নাম দিলেন। আপনার ২ নামের টাকাটা দুর্দশাগ্রস্ত ও অভাবীদেরকে দিলেন। অথবা ঈদের অন্যান্য খরচ থেকে বাঁচিয়ে আপনি করোনার্তদের দান করলেন। 

সে টাকায় হয়তো কয়েকটি পরিবারেরর ২/৩ মাস অভুক্ত কাটাতে হবে না। হয়তো এই করোনায় তারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেত, সেখানে আপনার কোরবানির মাধ্যমে তারা আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবার আশ্বাস পেল, লকডাউনের পর কাজে ফিরতে পারল।

সেই সাথে আপনি জানেন যে, দেশে এখন ধেয়ে আসছে বন্যা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশের ৩০ ভাগ এলাকা ডুবে যাবে এই বন্যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৯৮ এর বন্যার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে এর প্রভাব!

সঙ্ঘবদ্ধভাবে দিলে তা আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাবে

সঙ্ঘের মাধ্যমে দানের মূল কারণ হচ্ছে এখানে অনেকে একসাথে একত্র হয়ে অর্থটাকে জমিয়ে সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে পৌঁছে দেয়া যায়।

ধরুন আপনি নিজেই এই লকডাউনে বের হলেন মানুষকে দেবেন বলে। কিন্তু একই পরিবারের ৩ জন তিন পরিবারের সদস্য সেজে আপনার কাছ থেকে ৩ বার টাকা নিল। আপনি বুঝতেও পারলেন না।

আপনার প্রতিবেশীর কাছ থেকেও সে একই অভিনয় করে টাকা নিল। অথচ যে অভুক্ত, সে আপনার দুয়ারে এসে হয়তো চক্ষুলজ্জায় হাত পাততে পারল না। তাকে আপনি দেয়ার সুযোগও পেলেন না।

কিন্তু সঙ্ঘের একটি টিমই আছে যারা পুরো কাজটি একেবারে মাঠে নেমে করে থাকেন। 

একই সাথে, সঙ্ঘে অনেকে একসাথে মিলে দিলে অনেক বেশি দেয়া যায়। এবং এর পুরোটার সওয়াবের অধিকারী আপনি হবেন।   

এবারের ঈদুল আজহা স্রষ্টার নৈকট্য লাভের অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে

আসলে এবারের ঈদুল আজহা আমাদের জীবনে অনন্য একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ আমরা এবারের কোরবানিতে সরাসরি অসহায় ও অন্নহীন মানুষদের পাশে দাঁড়াবার সুযোগ পাচ্ছি।

একবার এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ (স) কে প্রশ্ন করলেন যে, ইসলামে কোন কাজটি শ্রেষ্ঠ?

জবাবে রসুলুল্লাহ (স) বললেন, ইসলামে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে ক্ষুধার্ত ব্যক্তিকে খাবার খাওয়ানো।[বুখারী হা/১২; মুসলিম হা/৩৯; মিশকাত হা/৪৬২৯]

তাই ক্ষুধার্তকে খাদ্য দানকারী ব্যক্তি সর্বোত্তম আমলকারী বলে গণ্য হবেন।

যেহেতু আমরা আগে থেকেই কোরবানির নিয়ত করে রেখেছি, তাই এবারের কোরবানিতে তার মাধ্যমে অন্নহীন, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসাটা আমাদের জন্যে আরও সহজ।

তাই আমরা চেষ্টা করব যে কোরবানির একাংশ বা কোরবানি ঈদের অন্যান্য খরচ বাঁচিয়ে যেন করোনার্তদের পাশে দাঁড়াতে পারি। ফাউন্ডেশনের অনলাইন ডোনেশন অ্যাপ ব্যবহার করে ঘরে বসেই আপনি রিলিফ ফান্ডে এই দান করতে পারেন। 

আসলে যদি আমরা দুর্গত মানুষের প্রতি সমমর্মিতা অনুভব করি; লকডাউনের ফলে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের কষ্টকে অনুভব করি, যাদের উপার্জন নষ্ট হয়ে গেছে; যারা মান-সম্মানের ভয়ে কারো কাছে হাত পাততে পারেন না তাদের প্রয়োজনটাকে যদি অনুভব করি এবং ভয়াবহ বন্যায় যাদের অবস্থা হয়েছে আরো সঙ্গীন তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সমমর্মিতা অনুভব করি, তাহলেই আমরা অন্তর থেকে বুঝতে পারব যে করোনাকালে কোরবানির এই সময়টা আমাদের সেই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াবার কতটা প্রয়োজন। 

স্রষ্টা আমাদেরকে সবাইকে কবুল করুন।