published : ২ সেপ্টেম্বর ২০২২
ইমাম বোখারী (রহ), এক মহাপুরুষ! স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা আর অটুট সততার এক মূর্ত প্রতীক।
ইমাম বোখারীর জন্ম ৮১০ সালের ২০ জুলাই উজবেকিস্তানের বোখারায়। তাঁর আসল নাম আবু আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল মুগিরা। তবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত জন্মস্থানের সাথে মিলিয়ে বোখারী নামে।
তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১ সেপ্টেম্বর ৮৭০ বোখারা ও সমরখন্দের মাঝামাঝি একটি স্থান ‘খারতাঙ্ক’-এ। হাদীস সংরক্ষণ ও সংকলনে অসামান্য শ্রম ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবদ্দশয়ায়ই তিনি লাভ করেন ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দীসের' মর্তবা।
এক রাতে ইমাম বোখারী (রহ) স্বপ্নে দেখেন তিনি রসুলুল্লাহর (স) সন্নিকটে পাখা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। নবীজীর (স) পবিত্র শরীরে মাছি বসছে, তিনি পাখা দিয়ে মাছি তাড়িয়ে দিচ্ছেন।
তিনি এই স্বপ্নের কথা সেই যুগের একাধিক আলেমের কাছে প্রকাশ করলে সকলেই বললেন যে, ভবিষ্যতে তুমি বানোয়াট ও জাল হাদীসগুলো আলাদা করে বিশুদ্ধ হাদীসের সংকলনকারী হবেন।
মূলত এই স্বপ্নই তাকে সহীহ হাদীস সংকলনে উদ্বুদ্ধ করে।
ইমাম বোখারী ছোটবেলাতেই বাবাকে হারান। বড় হতে থাকেন মায়ের তত্ত্বাবধানে। তার বিদ্যোৎসাহী মা জ্ঞানার্জনের জন্যে তাকে পাঠান সেসময়কার একজন প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মোহাম্মদ ইবনে সালামের কাছে।
মাতৃভাষা না হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোরআন শরীফ মুখস্থ করে ফেলেন মাত্র ন’বছর বয়সে!
১০ বছর বয়সে হাদীস মুখস্ত করতে শুরু করেন। অল্প সময়েই মুখস্ত হয়ে যায় ৭০ হাজার হাদীস!
ইমাম বোখারীর তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির কথা চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন জায়গা থেকে তিনি আমন্ত্রণ পেতে থাকেন স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা দিতে।
একবার আমন্ত্রণ আসে বাগদাদ থেকে। ইমাম বোখারী গেলেন। মসজিদে সবার সামনে বলতে দাঁড়াবেন, এমন সময়ে উপস্থিত মুহাদ্দিসদের একজন দাঁড়িয়ে একটি হাদীস বর্ণনাকারীর নামসহ বললেন। বর্ণনাকারীর নাম ইচ্ছে করেই ভুল বললেন।
ইমাম বোখারী বললেন, আমি এ হাদীসটি শুনি নি!
এভাবে আরো নয়টি হাদীস তিনি ভুল রেওয়ায়েতকারীসহ বলে গেলেন। ইমাম বোখারী প্রতিবারই বললেন তিনি হাদীসটি শোনেন নি।
বাকি নয়জন মুহাদ্দিসও প্রত্যেকে ১০টি করে হাদীস ভুল রেওয়ায়েতকারীসহ বলে গেলেন। তাদেরকেও ইমাম বোখারী একই কথা বলেন।
এরপর এলো ইমাম বোখারীর পালা। তিনি চাইলে একশটি হাদীস সঠিক বর্ণনাকারীসমেত বলে গেলেই পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে প্রত্যেকের প্রতিটি হাদীসের ভুল রেওয়ায়েতকারীসহ বলে তারপর সঠিকটা বলেন।
অর্থাৎ প্রথমে বলেন, আপনি বলেছেন ‘এভাবে’। কিন্তু আমি শুনেছি ‘এভাবে’।
ইমাম বোখারী ১৬ বছর বয়সে মা ও বড় ভাইয়ের সাথে হজ করতে মক্কায় যান। হজ শেষে মা এবং ভাই বোখারায় ফিরে এলেও তিনি মক্কায় থেকে যান এবং সেখানকার প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
সেখান থেকে তিনি যান মদিনায়।
শুধু মক্কা-মদিনা না, তখনকার দিনে ইসলামি জ্ঞানচর্চার প্রতিটি কেন্দ্র- মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে মিশর, মাঝখানে বাগদাদ, বসরা, নিশাপুর- জ্ঞান আহরণের জন্যে তিনি গিয়েছেন প্রতিটি জায়গায়।
তিনি নিজেই বলেছেন যে, তিনি ১০৭৮ জন মুহাদ্দিসের কাছ থেকে সরাসরি হাদীস সংগ্রহ করেছেন।
বোখারী শরীফের প্রতিটি হাদীস তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন মসজিদে নববীতে বসে।
মসজিদে নববীতে এসে ওজুর পর দু’রাকাত নামাজ পড়ে তিনি ধ্যানে বসতেন। আত্মনিমগ্ন হয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন হাদীসটি তিনি অন্তর্ভুক্ত করবেন কি না। যখন মন সায় দিত, তিনি তা লিপিবদ্ধ করতেন।
সহীহ এবং জয়িফের পার্থক্য তিনি শুধু বক্তব্যের ভিত্তিতে করতেন না। বর্ণনাকারীদের ধারাক্রম এবং সেই ধারাক্রমে কোথাও কোনো ফাঁক আছে কি না- এসবও খুঁটিয়ে দেখতেন।
যেমন- এক বর্ণনাকারী আরেক বর্ণনাকারী থেকে শুনেছেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দেখা হয়েছিল কি না, সরাসরি কথা হয়েছিল কি না এটা তিনি দেখতেন। বর্ণনাকারীর স্মৃতি ও প্রকাশ শক্তি কেমন ছিল বা তার জীবনে কোনো মিথ্যাচার আছে কি না- দেখতেন এসবও।
একবার তিনি ছয়মাসের পথ অতিক্রম করে এক মুহাদ্দিসের কাছে পৌঁছান একটি হাদীস সংগ্রহের জন্যে। সেখানে দেখেন মুহাদ্দিস তার ঘোড়াকে খাবারের লোভ দেখিয়ে ডাকছে, কিন্তু তার হাতে খাবার নেই!
এটা দেখে তিনি আর তার কাছ থেকে হাদীস সংগ্রহ করলেন না।
অর্থাৎ, ছয় মাসের পথ অতিক্রম করেও তিনি ফিরে এলেন একটিও হাদীস সংগ্রহ না করে! হাদীস সংকলনটির শুদ্ধতার ব্যাপারে এতটাই আপসহীন ছিলেন তিনি।
এত তীক্ষ্ণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির অধিকারী হওয়ার পরও ১৬ বছর এভাবে পরিশ্রম করেন ইমাম বোখারী।
সংকলন শেষে ইমাম বোখারী এটাকে কয়েকবার পরিমার্জন করেন। এরপর তাঁর শিক্ষক ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলসহ তখনকার দিনে যারা প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ছিলেন তাদেরকে তিনি এটা পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেন। পর্যালোচনা শেষে তারা এটাকে এক বাক্যে সহীহ হিসেবে রায় দেন।
ইমাম বোখারী তাঁর হাদীস সংকলনের নাম রেখেছিলেন ‘আল জামি আল সহীহ আল মুসনাদ আল মুখতাসর মিন হাদীস রসুলুল্লাহ ওয়া সুনানিহি ওয়া আয়ামিহি’। কিন্তু হাদীস সংকলনে তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও শ্রম গ্রন্থটির নাম তাঁর নামেই ইতিহাসে জায়গা করে দিল- ‘বোখারী শরীফ!’ বিশুদ্ধতম ও সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হাদীস সংকলন, পবিত্র কোরআনের পাশেই যার স্থান।
আসলে কাজ যখন কল্যাণ-অভিমুখী হয়, এবং সেই কাজে যদি কেউ নিজেকে সঁপে দিতে পারে তাহলে সেই কাজই তাকে পৃথিবীতে অমর করে দেয়- ইমাম বোখারী এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।