কেন করবেন গ্রুপ মেডিটেশন?

বলা হয়, এক মাথার চেয়ে দশ মাথা বেশি শক্তিশালী। একইভাবে একা মেডিটেশনে যে শক্তি সঞ্চার হয়, একসাথে অনেকে মিলে মেডিটেশন করলে সে শক্তি বেড়ে যায় বহুগুণ। 

যেমন ধরুন, আপনার খুব পছন্দের একটি গান প্রায়ই একা শোনেন। একদিন বেশ কিছু মানুষের সাথে মিলে গানটা শুনলেন। গানের তালে তালে আপনার সাথে বাকিরাও মাথা দুলাতে লাগল। দেখবেন একা গান শুনে যতটা না ভালো লেগেছিল, বাকিদের সাথে শুনে তার চেয়ে বেশি ভালো লাগছে।  

ঠিক একই ব্যাপার ঘটে গ্রুপ মেডিটেশনের ক্ষেত্রে। 

গ্রুপ মেডিটেশন - কোথায় কবে শুরু হয়েছিল?  

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই সকল সমাজে ভালো কাজ একসাথে করার রীতি চালু আছে। কারণ একসাথে করলে যে-কোনো কাজের শক্তি বেড়ে যায় বহু গুণ। 

প্রার্থনার কথাই ধরুন। প্রতিটি ধর্মেই একা একা প্রার্থনার পাশাপাশি একসাথে জড়ো হয়ে প্রার্থনা করার রীতি চালু আছে। এজন্যেই মসজিদ মন্দির গির্জা, যেখানে সমাজের অনেকে মিলে একত্র হয়ে ইবাদত উপাসনা করতে পারে। 

শিক্ষার বিস্তারও একইভাবে হয়ে আসছে। একত্রে বসে শিক্ষক বা গুরুর কাছ থেকে জ্ঞানচর্চা সেই আদিকাল থেকেই। কারণ অনেকের সাথে মিলে করলে জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ উদ্যম উদ্দীপনা বাড়ে বহুগুণ। 

আর ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, গুরু যোগী মুনী ঋষীরা নিজে ধ্যান চর্চার পাশাপাশি তাদের শিষ্যদের নিয়ে একসাথে ধ্যানচর্চা করেছেন। 

তাই বলা যায় যৌথ মেডিটেশন বা গ্রুপ মেডিটেশন নতুন কিছু নয়। এই চর্চা চলে আসছে সেই আদিকাল থেকেই। 

কেন গ্রুপ মেডিটেশন করবেন? 

বলতে পারেন, আপনি একাকী সকাল বিকাল দুবেলা মেডিটেশন চর্চা করছেন। মাথা ঠাণ্ডা থাকছে, মনটাও প্রশান্ত হচ্ছে। বেশ তো আছি! তাহলে আবার গ্রুপ করে মেডিটেশন করতে হবে কেন? 

এর অনেকগুলো উত্তর আছে।

১. নিমগ্ন হওয়া সহজ 

কোয়ান্টাম মেথড কোর্স, সাদাকায়ন বা আলোকায়নে যদি আপনি অংশ নিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে একাকী মেডিটেশনের চেয়ে অনেকের সাথে বসে মেডিটেশনে সহজেই মন বসে, মেডিটেটিভ লেভেল তুলনামূলক বেশি গভীর হয়। কারণ কী জানেন? কারণ হলো গ্রুপ মেডিটেশনে আপনার মস্তিষ্কের তরঙ্গ বা ব্রেনওয়েভ অন্যদের সাথে সমলয়ে (synchronized) চলে আসে, আপনি সহজেই একাত্ম হন অন্যদের সাথে। এতে স্থিতিশীল থাকে ধ্যানের স্তর। 

গ্রুপ মেডিটেশনে অংশগ্রহণকারীদের ব্রেন ওয়েভের synchronized হওয়ার বিষয়টি কিন্তু স্রেফ মুখের কথা নয়, রীতিমত ইইজি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত! 

২. সরাসরি চলে আসবেন গুরুর সংস্পর্শে 

ধ্যান একটি গুরুমুখী বিদ্যা। ধ্যান বা মেডিটেশন চর্চার ক্ষেত্রে শিক্ষক বা গুরু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজে নিজে মেডিটেশন শিখে যতটা না উপকৃত হবেন, একজন মেডিটেশন মাস্টার বা গুরুর কাছ থেকে শিখলে উপকৃত হবেন অনেক বেশি। যখন গুরু এবং সতীর্থদের সাথে সম্মিলিতভাবে মেডিটেশন করবেন, তখন আপনার মেডিটেশনে যোগ হবে আলাদা শক্তি। 

৩. মেডিটেশন চর্চা ধরে রাখা হয় সহজতর 

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততায় নতুন অভ্যাস গড়ে তোলা বেশ কঠিন। আপনি হয়ত ঠিক করলেন এখন থেকে নিয়মিত মেডিটেশন চর্চা করবেন। শতকরা ৯০% ক্ষেত্রে এই আবেগ দুয়েক সপ্তাহ পর আর থাকে না। 

দ্য আমেরিকান সোসাইটি অব ট্রেনিং এন্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষকরা দেখেছেন, একটি নির্দিষ্ট কাজ বা চর্চা আপনি সফলভাবে করতে পারবেন কিনা তার সম্ভাবনা এভাবে আঁচ করা যায়ঃ

যখন আপনি নতুন কোনো চর্চার ব্যাপারেচর্চা বজায় রাখার সম্ভাবনা
আইডিয়া করেন ১০%
সচেতনভাবে ঠিক করেন যে এটি করবেন ২৫%
দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেন যে অবশ্যই করবেন ৪০%
কাজটির ব্যাপারে পরিকল্পনা করেন ৫০%
জবাবদিহিতার ব্যাপারে কাউকে ঠিক করেন ৬৫%
তাকে রিপোর্ট করার জন্যে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেন৯৫%

গ্রুপ মেডিটেশনের ক্ষেত্রে তালিকার সর্বশেষ হিসাবটি প্রযোজ্য। বিষয়টি সাদাকায়ন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। 

প্রতি শুক্রবার শাখা-সেলগুলোতে ঠিক সকাল সাড়ে ৯টায় মেডিটেশন হয়। এই মেডিটেশনে অংশ নিতে হলে আপনাকে সুনির্দিষ্ট এই সময়টিতে নির্দিষ্ট স্থানে (শাখা-সেল) উপস্থিত থাকতে হবে। আপনি যদি নিয়মিত সাদাকায়নে অংশগ্রহণকারী হয়ে থাকেন তাহলে কোনো সাদাকায়ন মিস করলে শাখা-সেল থেকে আপনার খোঁজখবর নেয়া হবে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় পরোক্ষ জবাবদিহিতা। 

গবেষকদের হিসাবমতে, সাদাকায়নে অংশ নিলে আপনার মেডিটেশন চর্চা ধরে রাখার সম্ভাবনা দাঁড়াবে ৯৫%! 

৪. অটুট রাখে মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য  

আধুনিক সময়ে বেড়েছে একাকীত্ব ও বিচ্ছিন্নতা। কমে গেছে বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ। এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে দেহমনের স্বাস্থ্যের ওপর। 

একাকীত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মেদস্থূলতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, স্মৃতি দুর্বলতা। গবেষণা বলছে, দৈনিক ১৫টা সিগারেট খেলে শরীরে যে প্রভাব পড়ে, একাকীত্বের প্রভাব পড়ে এর সমপরিমাণ।

একাকীত্ব মহামারি থেকে বাঁচতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন বাস্তব সামাজিক যোগাযোগ বাড়াতে, নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মেলামেশা করতে। কিন্তু হুট করে বাস্তবে নতুন মানুষের সাথে পরিচয় বা মেলামেশা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব গ্রুপ মেডিটেশনের মাধ্যমে! 

চলে আসুন সাদাকায়নসহ ফাউন্ডেশনের উন্মুক্ত প্রোগ্রামগুলোতে। সদস্য হয়ে অংশ নিন বিশেষ প্রোগ্রামগুলোয়। নানান শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে বাস্তব মেলামেশা তো হবেই। উপরন্তু প্রোগ্রামের সুবাদে ফাউন্ডেশনে যাওয়া আসা ঘুচাবে আপনার শারীরিক নিষ্ক্রিয়তাও। 

৫. উপকার করছেন গোটা সমাজের  

অনেক মানুষ যখন নির্দিষ্ট কিছুতে মনোযোগ দেয়, তখন এর প্রভাব খুব শক্তিশালী হয়। 

Yale Journal of Conflict Resoultion ‘মহাঋষি ইফেক্ট’ নামে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, একটি সমাজে যদি ১% মানুষ মেডিটেশন করে তাহলে সে সমাজে ক্রাইম রেট কমে ১৬%! 

অর্থাৎ, কিছু মানুষ একত্রে মেডিটেশন করার মাধ্যমে গোটা সমাজকেই ইতিবাচকভাবে বদলে দিতে পারে।

কাজেই ধ্যান চর্চার মতন একটি কাজ সঙ্ঘবদ্ধভাবে করে আপনি শুধু নিজেরই নয়, উপকার করছেন গোটা সমাজের।