published : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
কথায় বলে, 'বনের বাঘে খায় না মনের বাঘে খায়।' মনের বাঘে যে কিভাবে খায় বাংলার প্রাচীন উপকথাই হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ :
জঙ্গলের মাঝে গভীর তপস্যায় নিমগ্ন এক যুবক। একাগ্রচিত্তে সে ধ্যান করে যাচ্ছে। ঈশ্বরের সন্তুষ্টি লাভে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে। বৈষয়িক কোনো ব্যাপারেই এখন তার কোনো আগ্রহ নেই। জঙ্গলে হিংস্র প্রাণীর কোনো অভাব না থাকলেও তার ভয়ডর বলে কোন কিছু ছিল না। সাধনার ফলে এই যুবক একদিন ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাভ করে। ঈশ্বর তাকে বর দেন, 'তুমি যা ভাববে, তা-ই হবে।'
ঈশ্বরের বর পেয়ে যুবক আত্মহারা। ভাবল এই গহীন জঙ্গলে সোনার এক বিশাল প্রাসাদ হলে কেমন হয়। সাথে সাথে হলোও তা-ই। আনন্দে লাফিয়ে উঠল সে। হঠাৎ মনে হলো ক্ষুধা লেগেছে তার। ভাবল সোনার থালায় সব সুস্বাদু খাবারের কথা। সাথে সাথে সামনে হাজির। মজাদার সব খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলল সে। শরীর এখন একটু বিশ্রাম চাচ্ছে। সোনার পালঙ্কে গা এলিয়ে দিল।
হঠাৎ তার মনে হলো প্রাসাদের মাঝে থাকলেও এর চারপাশে রয়েছে গহীন জঙ্গল। এখন যদি একটা বিরাট বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলে! আর যায় কোথায়! যেই মনে করা ওমনি এক বিরাট বাঘ এসে তাকে খেয়ে ফেলল। সোনার প্রাসাদে পড়ে রইল শুধু তার কয়েক টুকরো হাড়।
এ যুবক বছরের পর বছর জঙ্গলে কাটিয়েছিল, বাঘ তার ধারে কাছেও আসেনি। কিন্তু নিরাপদ সোনার প্রাসাদেও সে মনের বাঘ থেকে রেহাই পেল না।
গল্পটি থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, তাহলো কথা শুধু বাস্তবতার বিবরণই দেয় না, বাস্তবতা সৃষ্টিও করে। এক অনন্যসাধারণ দক্ষতা ও সম্ভাবনার উৎস হলো মানবমস্তিষ্ক। আর এ মস্তিষ্ককে চালায় মন। কাজেই মস্তিষ্কের ক্ষমতাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর বলেছেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে। মস্তিষ্ক হচ্ছে হার্ডওয়্যার আর মন হচ্ছে সফটওয়্যার। নতুন তথ্য ও নতুন বিশ্বাস মস্তিষ্কের নিউরোনে নতুন ডেনড্রাইট সৃষ্টি করে। নতুন সিন্যাপসের মাধমে তৈরি হয় সংযোগের নতুন রাস্তা। বদলে যায় মস্তিষ্কের কর্মপ্রবাহের প্যাটার্ন। মস্তিষ্ক তখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে নতুন বাস্তবতা উপহার দেয়।
নতুন বাস্তবতা ভাল হবে না খারাপ হবে, কল্যাণকর হবে না ক্ষতিকর তা নির্ভর করে মস্তিষ্কে দেয়া তথ্য বা প্রোগ্রাম-এর ভাল-মন্দের উপর। কল্যাণকর তথ্য ও বিশ্বাস কল্যাণকর বাস্তবতা সৃষ্টি করে আর ক্ষতিকর তথ্য বা বিশ্বাস ক্ষতিকর বাস্তবতা উপহার দেয়।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, জীবনের নতুন বাস্তবতার চাবিকাঠি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি বা নিয়ত। সাধারণত যারা অসুখী বা হতাশায় ভোগে বেশি তারা নেতিবাচক চিন্তা বেশি করে। তাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই। তারা কোনো পরিকল্পনা করতে পারে না। ফলে ব্যর্থ হয়। পরিণামে আরো বেশি হতাশায় ভোগে। নেতিবাচকতার শৃঙ্খলেই আবর্তিত হয় তাদের জীবন।
জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনাকে তাই আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। আপনি কী বলেন আর কী ভাবেন তার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
আপনি কি আত্মবিশ্বাসী? আপনার যা আছে তা নিয়ে কি আপনি কৃতজ্ঞ? আপনার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? যদি না হয়, তাহলে আপনাকে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ইতিবাচক চিন্তা করুন। এখন থেকে আপনি প্রতিনিয়ত কি শব্দ ব্যবহার করছেন সে ব্যাপারে সচেতন হোন।
আপনি কি ভাবেন, কি বলেন আর আপনাকে কি বলা হয় তা বিশ্লেষণ করুন। আপনার কথাবার্তা থেকে সকল নেতিবাচক শব্দ ও বাক্য বাদ দিন। কোনো নেতিবাচক শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলে সাথে সাথে 'তওবা তওবা' বা 'বাতিল বাতিল' বলুন। নেতিবাচক শব্দটিকে বাতিল করে দিন।
প্রতিদিন মনের বাড়িতে গিয়ে অন্তত একবার বলুন, 'অমূলক ভয়-ভীতি, নেতিবাচক চিন্তা ও কথার প্রভাব থেকে আমি সবসময় মুক্ত থাকব।' নেতিবাচক কথা হঠাৎ উচ্চারিত হলে ইতিবাচক কথা দিয়ে বক্তব্য শেষ করুন। ইতিবাচক কথাই আপনার জীবনে ইতিবাচক ফল আনতে সক্ষম।
আপনার অগ্রগতির পথে একটা বড় বাধা হতে পারে অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকার মানসিকতা। এ নিয়ে গল্প আছে।
এক এলাকায় প্রবল বন্যায় ঘরবাড়ি, গবাদি পশু, মানুষ সব ভেসে যাচ্ছে। এসময় একটি লোক আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগল, হে আল্লাহ তুমি আমাকে উদ্ধার কর। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল একটি নৌকা আসছে এদিকে।
মাঝি লোকটিকে নৌকায় উঠে আসতে বলল। কিন্তু সে রাজী হলো না। বলল, নৌকার দরকার নেই। আল্লাহই আমাকে উদ্ধার করবেন। নৌকা চলে গেল। পানি আরো বাড়তে লাগল। তার ঘরের অর্ধেকরও বেশি অংশ ডুবে গেল। সে ঘরের মধ্যে চৌকি দিয়ে মাচা করে তার ওপর উঠে দাঁড়াল।
এর মধ্যে সেনাবাহিনীর পেট্রোল বোট অর্থাৎ স্পীডবোট যখন এদিক দিয়ে যাচ্ছিল তাকে দেখল এবং বলল, উঠে এসো। আমরা বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করছি। সে তাদেরকেও বিদায় করে দিল এই বলে যে, আমি আপনাদের সাথে যাব না। আল্লাহই আমাকে উদ্ধার করবেন। স্পীডবোট চলে গেল।
এবার পানি বেড়ে তার ঘরের চাল পর্যন্ত উঠে গেল। সে গিয়ে দাঁড়াল চালের ওপর। এমন সময় ওপর দিয়ে আর্মির হেলিকপ্টার তাকে দেখতে পেয়ে সাথে সাথে রশি ফেলে বলল, এই রশি ধর। আমরা তোমাকে উঠিয়ে নিচ্ছি। সে বলল, আমি রশি ধরব না, আল্লাহই আমাকে উদ্ধার করবেন।
পানি আরো বাড়ল এবং পানিতে ডুবে সে শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। মারা গিয়ে যখন সে আল্লাহর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো, ফেরেশতাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বলল, আমি আল্লাহকে এত ডাকলাম, অথচ তিনি আমার কথা শুনলেন না।
ফেরেশতারা বলল যে দেখ, আল্লাহ তো প্রথমে ডিঙি নৌকা পাঠালেন, তারপর স্পীড বোট পাঠালেন, তারপর হেলিকপ্টার পাঠালেন। তারপরও যদি তুমি না ওঠ তাহলে আল্লাহ তোমাকে কীভাবে রক্ষা করবেন? কীভাবে বাঁচাবেন?
বেশিরভাগ মানুষের অবস্থা আসলে এরকমই। তারা ভাবে অমুকে তাকে সাহায্য করবে। অমুক একটু দেখলে বোধ হয় তার অবস্থা এরকম হতো না। তার তো কেউ নেই, তাই তার হবে না। বা তারা তাদের ব্যর্থতার জন্যে বাহ্যিক অবস্থাকে দায়ী করে। কিন্তু সফল মানুষেরা তাদের নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা নেয় এবং অবস্থা বদলাবার জন্যে নিজেরা উদ্যোগ নেয়।
তারা বিশ্বাস করে প্রতিকূলতা যতই থাকুক সেটাকে তারা অতিক্রম করতে পারবে। অন্যদের অপেক্ষায় না থেকে তারা নিজেরাই শুরু করে দেয়। কাজেই আপনার ব্যর্থতার কারণ আপনি নিজেই খুঁজে দেখুন। দেখুন বসের সাথে ভুল বোঝাবুঝি নিরসনে আপনি নিজে কী উদ্যোগ নিতে পারেন? বার বার কি আপনি একই ভুল করছেন? কাজ না করে কাজের প্রস্তুতি নিতে গিয়েই কি সময় নষ্ট করে ফেলছেন?
মানুষের অগ্রগতির পথে একটা বড় বাধা হলো জীবনের একটা বড় সময় সে কাটায় অলীক কল্পনায় ডুবে থেকে। যে কারণে বাংলায় একটা প্রবাদই আছে, 'ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা'। স্বপ্নে সে অনেক রাজা-উজির মারে কিন্তু বাস্তবে সেই অফিসের সেকেন্ড ক্লাস কেরানি। ফাইলে কলম পিষে বা দলিল নকল করেই কেটে যায় সারাজীবন। জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে অলীক কল্পনা নয়, দিবাস্বপ্ন নয়, প্রয়োজন হলো মনছবি। মনছবি আর দিবাস্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য হলো দিবাস্বপ্ন আপনাকে বাস্তববিবর্জিত একধরনের সুখকল্পনায় বিভোর রাখে এবং বাস্তবে কোনো কর্মতৎপরতা সৃষ্টি করে না।
অন্যদিকে মনছবি হলো মনের পর্দায় গভীর বিশ্বাস আর একাগ্র মনোযোগে লালিত সাফল্যের ছবি। অর্থাৎ আপনি যা হতে চান বা পেতে চান তা প্রথমত চাওয়া, 'পাবো' বলে বিশ্বাস করা এবং 'পাচ্ছি' বলে অনুভব করার নাম মনছবি। ইতিহাসে সফল মানুষরা কখনোই বিরাজমান অবস্থাকে মেনে নিতে পারেন নি, অন্যের সাফল্য দেখে বিস্মিত হন নি; বরং বিশ্বাস করেছেন যে বিস্ময় সৃষ্টি করার শক্তি তার নিজের মধ্যেই রয়েছে। পরিবর্তনের ক্রমাগত স্বপ্ন তাদের প্রেরণা যুগিয়েছে জীবন বদলাতে, নতুন বাস্তবতা গড়তে। মনছবি শুধু আশা নয়, মনছবি হলো বিশ্বাস ও কর্মে লালিত ভবিষ্যতের বাস্তবতা।
সাফল্যের পথে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো শর্টকাট খোঁজা। অর্থাৎ সে চায় অল্প আয়াসে কীভাবে পাওয়া যায়, পরিশ্রম না করে ফোকটে কীভাবে কামানো যায়। ফলে এরা প্রতারক-চালবাজদের কথা দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হয় যারা মিষ্টিকথার জাল বুনে মানুষের এই লোভাতুর স্বভাবের সুযোগ নেয়। এদের পরিণতি হয় গল্পের সেই রাখালের মতো।
এক পাহাড়ি গ্রাম। সেই গ্রামে এক প্রতারক ঢুকল। সে ছোটখাটো প্রতারণা করছে সফলভাবে। কিন্তু ঐ যে চোরের দশদিন গৃহস্থের একদিন। একদিন প্রতারকের প্রতারণা ফাঁস হয়ে গেল। গ্রামবাসীরা ধরে ফেলল তাকে। কিন্তু সকাল বেলা কাজে যাওয়ার সময় হওয়ায় তারা ঠিক করল আপাতত জঙ্গলে গাছের সাথে তাকে বেঁধে রাখা হোক। সন্ধ্যার সময় এসে পাহাড় থেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হবে, যাতে এই আপদ থেকে সবসময়ের জন্যে মুক্ত থাকা যায়। গ্রামবাসীরা প্রতারককে বেঁধে রেখে চলে গেল।
এর মধ্যে এক রাখাল মেষ চরাতে চরাতে ওখানে চলে এল। রাখাল ছিল সহজ-সরল এক যুবক। সে প্রতারককে ঐ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, তোমার এ অবস্থা কেন? প্রতারক তার কথা শুনেই বুঝল যে, এ লোক এই গ্রামের নয়। সে সাথে সাথে ফন্দি বের করে ফেলল।
সে বলল যে, দেখো, আমার দুঃখের কথা তুমি শুনে কী করবে? আমার অনেক দুঃখ! রাখাল বলল- কী দুঃখ? প্রতারক বলে যে, দেখ, আমি একজন সাধক মানুষ, সাধনা করতে চাই। আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছু আমি পেতে চাই না। আমি ঘর সংসার করতে চাই না। কিন্তু এই গ্রামের লোকজন আমাকেই ধরেছে যে, সর্দারের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। কারণ, এই গ্রামে সর্দারের মেয়েকে বিয়ে করার মতো আর কোনো পুরুষ নাই আর তাকে আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই বিয়ে দিতে হবে। নইলে মেয়েটি বাঁচবে না। এখন আমাকে সবাই ধরেছে যে, মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে। সেই সাথে সর্দারের যে সম্পত্তি, তার অর্ধেক আমাকেই নিতে হবে।
এখন বল, আমি একজন সন্ন্যাসী গৃহত্যাগী মানুষ, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো কিছু বুঝি না আমি। আমাকে এই কাজ করতে হবে! আমার ওপর এই জুলুম! শুনতে শুনতে রাখাল ছেলেটি লোভাতুর হয়ে উঠল। জিজ্ঞেস করল, আমার সাথে কি বিয়ে দেবে? প্রতারক বলল, ছেলে পেলেই বিয়ে দেবে। কারণ এ গ্রামে আর কোনো ছেলে নেই।
রাখাল তখন বলল যে, তোমার ওপর এই জুলুম দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছে। তুমি তো সন্ন্যাসী, তোমার বিয়ের দরকার নেই। কিন্তু আমার তো বিয়ের দরকার আছে। এক কাজ করি। তোমাকে আমি খুলে দিচ্ছি। তুমি আমার এ ভেড়াগুলো নিয়ে চলে যাও। আর আমাকে এখানে বেঁধে রাখো যাতে সন্ধ্যার সময় তারা এখানে এসে আমাকে পায়।
প্রতারক বুঝল যে, শিকারি টোপ গিলে ফেলেছে। তবুও মুখ শুকনো করে বলল, তোমাকে আবার এই বিপদের মধ্যে ফেলব! সর্দারের মেয়ে দেখতে কেমন জানি না, মেজাজি কিনা তা-ও জানি না। কিন্তু যুবক তো তখন ভীষণ উত্তেজিত। বলে যে, আমি পুরুষ মানুষ, রাগী হয়েছে তাতে কী? রাগ আমি ঠিক করে ফেলব। বলে সে প্রতারকের বাঁধন খুলে দিল।
প্রতারক তখন রাখালকে আচ্ছামতো বেঁধে ভেড়াগুলো নিয়ে সরে পড়ল। সন্ধ্যার সময় লোকজন মশাল জ্বালিয়ে এসেছে, পাহাড় থেকে প্রতারককে ফেলে দেবে বলে। রাখাল নানানভাবে প্রতিবাদ করতে চাইলেও কেউ তার কথা শুনল না। তারা ভাবল প্রতারক তো কত কথাই বলে!
কিন্তু পরদিন সকালবেলা গ্রামবাসী তো অবাক! প্রতারক ভেড়ার বিশাল পাল নিয়ে গ্রামের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রামবাসী বলল, এই তোমাকে না ফেলে দিয়েছিলাম সমুদ্রে! তুমি এখানে এলে কীভাবে?
প্রতারক তখন বলল,আর বলো না! তোমরা আমাকে ফেলেছিলে ঠিকই। কিন্তু এ সমুদ্রে আছে এক জ্বীনের বাদশার রাজত্ব। সে খুব দয়ালু। আমাকে ওখানে ফেলে দেয়ার সাথে সাথে সে আমাকে তুলে নিল। বলল যে, আমাদের এ রাজ্যে কারো মরার নিয়ম নেই। কেউ মরবে না। তুমি যেহেতু এসেই পড়েছ, এ রাজ্যের নিয়ম অনুসারে তোমাকে এই ১০০ ভেড়া দিয়ে দেয়া হলো। আমি ভেড়া নিয়ে চলে এলাম।
এখন গ্রামবাসী জিজ্ঞেস করল- যে পড়বে তাকেই দেবে? বলে যে, হাঁ। ঐ রাজ্যের নিয়মই তাই। ব্যস, গ্রামের পুরুষরা সব বাড়ি-ঘর ক্ষেত-খামার গবাদি পশু ফেলে পাহাড় থেকে লাফিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে লাগল। আর ঐ প্রতারক গ্রামের জায়গা-জমি-সম্পত্তি সবকিছুর মালিক বনে গেল।
সুতরাং ফোকটে পাওয়ার প্রত্যাশা করবেন না। ফোকটে যা পাওয়া যায় তা কখনো নির্ভেজাল হয় না। এমনকি ঘটনাচক্রে আপনি যদি পেয়েও যান আপনি তা ধরে রাখতে পারবেন না।
বিবিসি একবার মিলিয়ন ডলার লটারি জিতেছে এমন বেশ কয়েকজনকে নিয়ে একটা জরিপ করেছিল টাকা পাওয়ার পর তাদের কার অবস্থান কেমন সেটা যাচাইয়ের জন্যে। তারা দেখল, লটারি বিজয়ী অধিকাংশই আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। পুরস্কারের এত বিপুল অর্থও তাদেরকে সাময়িক কিছু বিলাস-ব্যসনের যোগান ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে নি।
একজন সফল মানুষ যে ব্যর্থ হন না, তা নয়। কিন্তু তিনি তার প্রতিটি ব্যর্থতা থেকে শেখেন। ব্যর্থতা তাকে হতোদ্যম না করে নতুনভাবে, নতুন কৌশলে কাজ করার উদ্দীপনা যোগায়। আর সাধারণ মানুষ ভুল থেকে শেখে না। একই ভুল বারবার করে।
এ বিষয়ে মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের একটি ঘটনা আছে। রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। বড় ভাই যুধিষ্ঠিরের তেষ্টা পেল। ছোট ভাই গেলেন তার জন্যে পানি আনতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি হ্রদ দেখতে পেয়ে যে-ই না আঁজলা ভরে পানি নিতে গেলেন, অমনি দৈববাণী শুনলেন, থামো! পানি নেয়ার আগে তোমাকে একটি প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আর জবাব দিতে না পারলে তোমাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
প্রশ্নটি হলো- জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য কী? ছোট ভাই জবাব দিতে পারল না। সাথে সাথে মারা গেল। চতুর্থ, তৃতীয়, দ্বিতীয় ভাইও একে একে এল এবং জবাব দিতে না পেরে মৃত্যুমুখে পতিত হলো। সবশেষে এলেন যুধিষ্ঠির। এসে দেখলেন হ্রদের তীরে মৃত চার ভাইকে। দৈববাণী তাকেও একই প্রশ্ন করল। যুধিষ্ঠির জবাব দিলেন, 'মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো মানুষ কখনো শিখতে চায় না।' যুধিষ্ঠিরের জবাব সঠিক ছিল।
দৈববাণী তখন বলল, তুমি যা বলেছ তা ঠিক। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে তোমার ভাইদের চোখে মুখে ছিটিয়ে দাও, তারা আবার প্রাণ ফিরে পাবে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের প্রধান কারণ হলো যে তারা ভুল থেকে শেখে না। তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় না। স্বভাব বা কৌশলের যে ত্রুটির কারণে সে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে, সেগুলোকে শোধরাবার কোনো উদ্যোগ তার থাকে না।
অধিকাংশ মানুষের বৃত্ত হলো তারা একই ভুল বার বার করে। যেমন, দৈনন্দিন জীবনেও সে একই ভুল অভ্যাস, আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গিরই পুনরাবৃত্তি করে এবং সমস্যায় পড়ে। যেমন, স্বামী-স্ত্রী হয়তো রাগারাগি বা ঝগড়া করছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই ঝগড়া, মনোমালিন্য একই ইস্যু নিয়ে, একই প্যাটার্নে।
আবার একজন ছাত্র/ছাত্রী পরীক্ষায় খারাপ করছে হয়তো অমনোযোগের কারণে, সময় নষ্ট করার কারণে বা বিশেষ কোনো ভুলের কারণে। ভালো রেজাল্ট করতে চাইলেও এই ভুলগুলো সে শোধরাচ্ছে না।
আবার কেউ হয়তো সময় মেনে চলে না। এর জন্যে অনেক রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও যে কারণগুলোর জন্যে তার দেরি হয় সে কারণগুলো সে দূর করছে না। এবং বারবার সময় মতো কাজ না করার ভোগান্তি পোহাচ্ছে।
কেউ হয়তো বার বার প্রেমে পড়ছে এবং দুর্ভোগে পড়ছে। কিন্তু কিছুদিন পরই সে একই ধরনের ছেলে বা মেয়ের পাল্লায় একই রকমভাবে প্রতারিত হয়ে প্রেমের দুর্ভোগে পতিত হচ্ছে। কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ ভুল থেকে শেখে এবং কার্যকারণ বুঝতে পারে যে কেন এটা হচ্ছে? ভুলগুলো বিশ্লেষণ করে সমস্যাকে তারা উৎপাটন করে মূল থেকে। আর এর জন্যে মেডিটেশন হলো সবচেয়ে ভালো উপায়। মেডিটেশনের গভীর তন্ময়তায় সে তার ভুল বুঝতে পারে, শোধরাতে পারে। বেরুতে পারে ভুলের বৃত্ত থেকে।