যখন একটি দেশে কর্মক্ষম (working-age) মানুষ (১৫-৫৯ বছর) বাকিদের (non-working age people) চেয়ে বেশি হয়, তখন দেশটির জন্যে সূচিত হয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বড় সম্ভাবনা। এই অবস্থাকে বলা হয় হয় 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড'।
বাংলাদেশে এখন এই বয়স শ্রেণির মানুষ জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ; উপরন্তু জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। ফলে বাংলাদেশের জন্যে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অনন্য সাধারণ সুযোগ। তবে দেশ কতটা সমৃদ্ধ হবে তা বহুলাংশেই নির্ভর করছে তরুণরা নিজেদের কতটা বিকশিত করবে তার উপর।
ধারণা করা হচ্ছে 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড' সুবিধার দুয়ার ২০৪০-এর মধ্যে বন্ধ হতে শুরু করবে। কাজেই উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হাসিলে এই পর্যায়টির সদ্ব্যবহার জরুরি। আর সেজন্যে যা করার তা শুরু করতে হবে এখনই।
আপনার বয়স কি ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে? হয়ে থাকলে আপনাকে অভিনন্দন! আপনি তরুণ, আপনি সেই বয়সে আছেন যে বয়সে কেউ, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায়, ‘স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি’, যে বয়সে ‘বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি’, যে বয়স ‘বিপদের মুখে অগ্রণী’।
আসলে দুঃসাহসী উদ্যোগ বা ঝুঁকি গ্রহণে প্রয়াসী হওয়া আপনার পক্ষেই সম্ভব। কারণ তারুণ্য এক দুর্বার শক্তি, যা আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে। এই শক্তির নিয়ন্ত্রিত ও কল্যাণকর ব্যবহারে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর আপনি নিজে যখন বিকশিত হবেন তখন আপনার হাত ধরে জাতীয় সমৃদ্ধিই আসবে শুধু না, আপনি নিজেও হবেন সাফল্যমণ্ডিত।
তবে এ-জন্যে প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়, সৃজনশীলতা, মুক্ত বিশ্বাস, সঠিক জীবনদৃষ্টি আর ইতিবাচক মনোভাব।
আরো পড়ুন :
আমাদের অনেক শিক্ষার্থীরই এখন নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই; থাকলেও সেটা অপূর্ণাঙ্গ। শৈশবের লক্ষ্য কৈশোরে গিয়ে বদলে যায়, সেটাও আবার বদলে যায় তারুণ্যে পৌঁছে।
জরিপে দেশের তরুণরা জীবনের যে লক্ষ্যগুলোর কথা বলেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে ‘কমন’ দুটি হলো- উচ্চশিক্ষা এবং সরকারি চাকুরি।
ধরুন, আপনি পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন, পড়ালেখা শেষে সরকারি চাকুরিও পেলেন; কিন্তু এরপর?
আসলে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ, তা অর্জনের প্রয়াস, লক্ষ্যপূরণ, তারপর আবার একটি লক্ষ্য নির্ধারণ- এই চক্রটিই আমাদের ভালো থাকার রসদ জোগায়। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে।
তবে কেবল বস্তুগত প্রাপ্তি, অর্থাৎ গাড়ি-বাড়ি বা ধন-সম্পদ না, স্বাস্থ্য পরিবার আত্মিকতা ইত্যাদি বিষয়েও থাকা উচিত নির্দিষ্ট লক্ষ্য। কারণ কেবল বস্তুগত প্রাপ্তির পেছনে ছুটলে জীবন-সন্তুষ্টি কমে যায়- স্রেফ কথার কথা নয়, বহু গবেষণার ফলাফল এটা।
তাই আপনার লক্ষ্য বা মনছবি হতে পারে- আপনার পরিবার আলোকিত পরিবার হচ্ছে, আপনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলছেন, কর্মময় সুখী জীবনযাপন করছেন, বার্ধক্যেও সুস্থ-সবল-সচল-কর্মক্ষম আছেন, নিজেকে পরিণত করেছেন লাখো মানুষের ভরসাস্থলে, যাদের অশ্রুতে আপনি নিচ্ছেন শেষ বিদায়।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে তরুণদের মধ্যে দুটি ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি-
১. ‘অমুক’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অমুক’ সাবজেক্টে না পড়লে লাইফ শেষ, এবং
২. চাকুরিই যদি না করি তো উচ্চশিক্ষার কী দরকার!
আসলে আপনি জীবনে কী হতে চান সাবজেক্ট চয়েস হবে সেটার আলোকেই; ব্যাচের অন্যরা কী করছে, বা কোনটা ‘টপ সাবজেক্ট’ সেই বিবেচনায় নয়। এবং, পছন্দের সাবজেক্ট যেখানে পাবেন সেখানেই পড়বেন।
আর আপনি চাকুরি করেন বা না-ই করেন, উচ্চশিক্ষাকে অবহেলা করবেন না।
বলবেন, উচ্চশিক্ষা ছাড়াই তো অনেকে সফল হয়েছে! আসলে উচ্চশিক্ষা ছাড়াই আপনি সফল হতে পারেন; কিন্তু এর ঘাটতি পূরণ হবার নয়।
দেশের এক বড় শিল্পপতি। দেশে বিজনেসের পাশাপাশি বিদেশের সাথেও লেনদেন ছিল। তবে তিনি লেখাপড়া জানতেন না।
একবার এক বিদেশি ব্যবসায়ীর সঙ্গে নেগোসিয়েশন হচ্ছে। তিনি ইংরেজি না জানায় কথা যা বলার তা তার ম্যানেজারই বলছেন। অনেকক্ষণ এভাবে চলার পর ভদ্রলোকের মনে হলো, অল্প একটুর জন্যে সমঝোতা হচ্ছে না; এখন ‘ইয়েস’ বললেই হয়। তিনি অধৈর্য হয়ে ‘ইয়েস’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
ম্যানেজার বিস্ময়ে হতবাক! কারণ নেগোসিয়েশনটিকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার ঠিক আগ মুহূর্তেই তার বস ‘ইয়েস’ বলে ফেলেছে। এবং ঐ একটি ‘ইয়েস’-এর জন্যে তার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছিলো ‘মাত্র’ দেড় কোটি টাকা!
ক্যারিয়ার প্ল্যানে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার জজ-ব্যারিস্টার বিসিএস আর ব্যাংক জবের বাইরে কিছু যেন ভাবতেই পারছে না এখনকার বেশিরভাগ তরুণ।
কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের বিসিএস চাকুরির জন্যে মরীয়া প্রয়াস চালাতে দেখা যাচ্ছে। গ্রাজুয়েশন লেভেলের অনেকেই একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে বিসিএসের প্রস্তুতিই নিচ্ছে বেশি। ৪১তম বিসিএসে আবেদন করেছিল প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী। পৃথিবীতে অন্তত ২৮টি দেশ আছে যেগুলোর জনসংখ্যা এর চেয়েও কম!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, একেকটি পদের বিপরীতে চাকুরিপ্রার্থী ২২০ জন, চাকুরি পাবে ১ জন; তাহলে বাকি ২১৯ জনের কী হবে?
৫/৬ বার চেষ্টাতেও বিসিএসে উৎরাতে না পেরে যখন তারা অন্য কোথাও চেষ্টা করছে ততদিনে মেধার ‘ধার’ কমে গেছে। উপরন্তু সরকারি চাকুরির প্রস্তুতি নেয়ার তোড়জোড়ে একাডেমিক পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট এবং দীর্ঘকাল ‘বেকার’ থাকাটা চাকুরিদাতার মনে চাকুরিপ্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে জন্ম দিচ্ছে নেতিবাচক ধারণার।
আপনার মেধার সঠিক মূল্যায়ন হয় এমন যে-কোনো কাজই আপনি পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন। হতে পারেন উদ্যোক্তা।
গত কয়েক বছরে ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ডিজিটাল এন্ট্রেপ্রেনিওরশিপের জগতে তৈরি হয়েছে অসাধারণ সব কাজের সুযোগ। কিন্তু ঝুঁকিগ্রহণে সাহসের অভাব, পড়ালেখা শেষ করেই ভালো একটা চাকুরি আর অল্প শ্রমে বাড়ি-গাড়ির বাসনা এই সুযোগগুলো গ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য ইদানিং স্বাধীন পেশা বা স্টার্ট আপের দিকে অনেক তরুণই ঝুঁকছে। তবে সেখানেও ঘাটতি আছে অভিনব আইডিয়ার।
এক ডিজিটাল উদ্যোক্তা এদেশের তরুণদের কাছ থেকে কিছু স্টার্ট-আপ আইডিয়া চেয়েছিলেন। হাজারখানেক পেয়েছেনও। তবে এগুলোর সাতশ’র বেশি ছিল অনলাইনে জামাকাপড় কিংবা গ্যাজেট কেনাবেচা!
আরো পড়ুন :
দুনিয়াজুড়ে ব্যবসায় অঙ্গনে এখন আইডিয়ার জয়জয়কার। নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে গড়া অনেক স্টার্ট-আপই পেয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। আজকের দিনে গুগল অ্যাপল উবার ফুডপান্ডাসহ সফল অনেক প্রতিষ্ঠানই শূন্য থেকে পূর্ণতায় পৌঁছেছে সৃজনশীলতার গুণে।
রাইড শেয়ারিং স্টার্ট-আপগুলোর কথাই ধরুন। কী করছে এরা? অনলাইনে চালকের সাথে যাত্রীর যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে। স্রেফ এটুকুর বিনিময়ে সার্ভিস চার্জ বাবদ তারা যা নিচ্ছে তাতে ফুলেফেঁপে উঠেছে তাদের আর্থিক স্বাস্থ্য। নতুন আইডিয়ার মাহাত্ম এটাই।
আসলে কেবল চাকুরি করে খুব বেশি দূর যাওয়া যায় না। চাকুরি করে কতটা আয় করতে পারবেন- মাসে এক লাখ? দু’লাখ? পাঁচ লাখ? বেতনের একটা সীমা তো আছে! তাই চিন্তা করুন গতানুগতিকতার চার দেয়ালের বাইরে।
ইতিহাস বলে, অনেক বড় বড় সফল প্রতিষ্ঠান শুরুতে ছিল নিছক 'ক্রেজি' বা খ্যাপাটে আইডিয়া!
আরো পড়ুন :
ব্র্যাক, বিআইজিডি এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী চার হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর ওপর একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, এদের মধ্যে ইংরেজি ভাষা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতায় আত্মবিশ্বাসী মাত্র ১৬ শতাংশ!
ইংরেজিতে দক্ষতা আছে তরুণ ও তরুণীদের যথাক্রমে ২৪ ও ১০ শতাংশের। কম্পিউটারে দক্ষতার ক্ষেত্রে এই হার যথাক্রমে ২১ ও ১৪ শতাংশ।
কাজেই লিখিত ও স্পোকেন ইংরেজি এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে যদি আপনি দক্ষ হতে পারেন তাহলে পেশাজগতের ‘ঘোড়দৌড়ে’ এগিয়ে থাকবেন অনেকের চেয়ে!
দেশে কোনো ‘ফিউচার’ নেই; ইউরোপ-আমেরিকায় হায়ার এডুকেশন নিতে গিয়ে ওখানেই সেটেলড হও- এরকমই ভাবনা এখনকার অনেক তরুণের।
আপনিও যদি এই দলের একজন হয়ে থাকেন তাহলে আপনার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন- মোটামুটি মানের নিজের বাড়ি আর ঝাঁ চকচকে ভাড়া বাসার মধ্যে কোনটাকে বেঁছে নেবেন আপনি? নিশ্চয়ই প্রথমটার কথাই বলবেন! কারণটা কবিতার সেই বাবুই পাখির ভাষায় ‘নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা!’
হ্যাঁ, আপনি ফুল স্কলারশিপে উচ্চতর শিক্ষার জন্যে বিদেশে যেতে পারেন। কিন্তু ঋণ করে বিদেশে গেলে, বা ওখানে গিয়ে চাকুরি করে পড়াশোনা করবেন- এ উদ্দেশ্যে গেলে পরবর্তীতে আপনাকে পস্তাতে হতে পারে। আবার স্কলারশিপ পেলেও অনুচিত হবে সেসব ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাওয়া, যেগুলোর সার্টিফিকেটের গ্রহণযোগ্যতা নেই।
আর শুধুমাত্র অর্থ উপার্জন বা একটু আরাম-আয়েশে জীবন কাটানোর জন্যে যদি আপনি বাইরে যান, আপনি তৃপ্তি পাবেন না। কারণ সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেনের জীবন একটা বয়সে এসে প্রবাসীদের মধ্যে হাহাকার সৃষ্টি করে। এর চাইতে আপনার মেধাকে দেশে ব্যয় করলে দেশ উপকৃত হবে, আপনারও জীবনও হবে অর্থবহ।
ইদানিং তরুণদের একটি বড় অংশ দেশ নিয়ে হতাশায় ভুগছেন, যার প্রকাশ ঘটছে তাদের আলাপচারিতা বা লেখালেখিতে।
দেশে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রিয় ঘটনা বা অঘটন ঘটছে ঠিকই। তবে আমাদের ইতিবাচক অর্জনের পরিমাণও কিন্তু কম নয়! গেল কয়েক দশকে দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, সেবা, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে; আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নতুন আশাবাদ।
সূরা রাদের ১১ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেছেন, নিজের ভেতর থেকে না বদলালে (অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গি না বদলালে) আল্লাহ কোনো জাতির (বা মানুষের) অবস্থা বদলান না।
অর্থাৎ, দেশের বর্তমান অবস্থা বদলের জন্যেও জরুরি দেশ নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ। তরুণ সমাজের একজন হিসেবে যখন আপনি দেশের সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদী হবেন, নিজের কাজটুকু সবচেয়ে ভালভাবে করতে প্রয়াস চালাবেন, দেশকে সোনালী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেয়ার শুরুর পদক্ষেপ হবে সেটাই।
আরো পড়ুন :