অ্যা ডলস হাউজ-পুতুলের সংসার!

অ্যা ডলস হাউজ- পুতুলের সংসার। বিশ্বসাহিত্যের সবচেয়ে আলোচিত ও মঞ্চস্থ নাটকগুলোর একটি। দেড়শ বছর আগে নরওয়ের প্রখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন নাটকটি লেখেন। উনিশ শতকের ইউরোপে পুরুষশাসিত সমাজে একজন বিবাহিত নারীর জীবন কতটা পরাধীন আর মর্যাদাহীন ছিল- তারই রূপক এ নাটকটি।

নাটকের প্লট

নোরা নামের তিন সন্তানের জননী এক গৃহবধূ আর তার ব্যাংকার স্বামী টরভাল্ডকে নিয়ে নরওয়ের শহর সিরকাতে গড়ে ওঠে এ নাটকের প্লট। নাটকের শুরুতেই নোরাকে দেখা যায়- বড়দিন উপলক্ষে বাজার থেকে কেনা একগাদা উপহারসামগ্রী নিয়ে স্বামীর ঘরে ঢুকছে।

স্ত্রীর হাতে এত দামি দামি উপহার দেখে টরভাল্ড কিছুটা ঠাট্টাচ্ছলে নোরাকে তিরস্কার করে- নোরা, গত বছরও তো তুমি সবাইকে অনেক উপহার দিয়েছ। কিন্তু সেগুলো সবই ছিল তোমার নিজের হাতে বানানো। খরচ বাঁচানোর জন্যে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে একটা একটা করে তুমি হাতে তৈরি করেছিলে।

কিন্তু এবার এমন কী হলো যে এত দরাজ-হস্ত হয়ে গেলে? খরচের চিন্তা না করে দোকান থেকে দামি সব উপহার কিনে আনছ! ব্যাংকে আমার একটা পদোন্নতি হতে পারে- শুধুমাত্র এ খবরই কি তোমাকে এত বিলাসী করে ফেলছে!

বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে!

আসলে নোরার এই বিলাসী আচরণের পেছনে ছিল এক গোপন ঘটনা। নরওয়ের সমাজে সেসময় স্বামীর অনুমতি ছাড়া কোনো নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারত না।

কিন্তু নোরা চেয়েছিল তার অসুস্থ স্বামীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্যে তাকে ইতালি বেড়াতে নিয়ে যেতে। কিন্তু সেজন্যে যে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন, তার স্বামীর তা ছিল না।

নোরা তাই তার মৃত বাবার স্বাক্ষর জাল করে তার স্বামীরই ব্যাংক থেকে বেশ পরিমাণ টাকা ধার করে। নোরা ভেবেছিল, অল্প অল্প করে জমিয়ে এ ধার সে নিজেই শোধ করে ফেলতে পারবে! স্বামীকে কিছুই জানাতে হবে না।

শিকার হলো ব্ল্যাকমেইলের

কিন্তু সেটা হয় নি। নোরার স্বামীর ব্যাংকের এক অসাধু কর্মচারী নিজেকে বরখাস্ত হওয়া থেকে বাঁচাতে নোরাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। নোরার গোপনে ঋণ করার ব্যাপারটা সে জানত। অতএব নোরাকে সে ভয় দেখাল- স্বামীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সে যদি তাকে বরখাস্ত করা থেকে বিরত করতে না পারে, তাহলে নোরার এই গোপন ব্যাপারটা সে ফাঁস করে দেবে।

কাহিনী এভাবেই এগোতে থাকে। ব্ল্যাকমেইলের আতংক, স্বামীর মানসিক নির্যাতন, সম্মানহানির ভয়, সর্বোপরি ঋণশোধের চাপ- সব মিলিয়ে নোরা এমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল যে এক পর্যায়ে সে আত্মহত্যা করার কথাও ভাবে। শেষ পর্যন্ত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তিলতিল করে গড়া এতদিনের সংসার ফেলে চলে যেতে হলো তাকে।

ঋণ ঢোকে যে পরিবারে...

নারীর স্বাধীন সত্তার গুরুত্বকে সার্থকভাবে তুলে ধরার জন্যে বিখ্যাত হলেও এ নাটকের মূল বিষয় ছিল পণ্যাসক্তি এবং ঋণ। নোরা কিন্তু ঋণ করতে প্রলুব্ধ হয়েছিল খাওয়া-পরার মতো কোনো মৌলিক প্রয়োজনে নয়, বরং মানুষকে দামি উপহার দিয়ে নিজের স্ট্যাটাস বাড়াতে কিংবা বিদেশ ভ্রমণের মতো বিলাসী চাহিদা মেটাতে। হেনরিক ইবসেন নিজেই বলেছেন, যে পরিবারে ঋণ ঢোকে সে পরিবারে সুখ এবং শান্তি সব বিনষ্ট হয়ে যায়।

বাস্তবতা কি বদলেছে!

আজ দেড়শ বছর পরও কি এ বাস্তবতার খুব বেশি বদল ঘটেছে? না। আসুন, দেখি কয়েকটি ঘটনা।

ঘটনা-১

বিয়ের বিলাসবহুল আয়োজনের খরচ মেটাবার জন্যে ঋণ করল এক তরুণ। দ্রুত ঋণশোধের আশায় ঋণের বাকি টাকা শেয়ারবাজারেও লাগাল। কিন্তু শেয়ারবাজারে নামল ধ্বস। তখন আরো ঋণের জন্যে ধর্না দিল আরেক ব্যাংকে। ব্যাংক যখন ঋণশোধের চাপ দিল তখন ধার করতে লাগল বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছ থেকে। এখন ব্যাংক, বন্ধু, আত্মীয় সবাই তার পাওনাদার। সংসারের খরচই যেখানে যোগাতে পারে না, ঋণশোধ তো পরের কথা। সবার ভয়ে পালিয়ে বেড়ায়। সংসারেও নেই শান্তি। এত ধুমধাম করে বিয়ে করে যে স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে এসেছে বাজারখরচ দিতে না পারায় এখন প্রতিদিনই তার সাথে ঝগড়া হয়।

ঘটনা-২

আমার ঋণের পরিমাণ এক কোটি টাকা। চেয়েছিলাম ফ্ল্যাট বিক্রি করে ঋণটা শোধ করব। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে পারছি না।

জীবিকার জন্যে আমার একমাত্র অবলম্বন একটি সফটওয়ার কোম্পানিতে চাকরির ১৮ হাজার টাকা বেতন আর অল্প কিছু ফ্ল্যাট ভাড়া।

কিন্তু ঋণশোধের উপায় কী! শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবেচিন্তে বেছে নিলাম এই পথ-

অফিসের কাজে প্রায়ই আমাকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হয়। এসি বাসে যাওয়া, এসি রুমে থাকা এবং সিএনজিতে যাতায়াতবাবদ আমাকে যে ভ্রমণ ভাতা দেয়া হয়, তার বেশিরভাগটাই আমি বাঁচাই সাধারণ বাসে গিয়ে, সাধারণ রুমে থেকে এবং লোকাল বাসে চড়ে।  

বাঁচানো এই টাকাটা দিয়ে একটু একটু করে হলেও শোধ করছি আমার ঋণ।

শুধু তাই নয়। মাসে দুবার লোক দিয়ে অফিস পরিষ্কারের জন্যে কিছু টাকা আমাকে অফিস দেয়। আমি সেই টাকাটা নিজের কাছে রেখে পরিচ্ছন্নতার কাজটা নিজেই করি।

রাতে যখন সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে যায়, তখন পুরো অফিস ঝাড়ু দিয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখি। বেসিন-টয়লেট ক্লিন করি।

আমি জানি না, আমি অন্যায় করছি কি না। কিন্তু যে বিশাল ঋণের বোঝা আমার ওপর চেপেছে, তা থেকে বৈধভাবে মুক্তির আর কোনো উপায় আমার সামনে নেই।

ঘটনা-৩

২০০৭ সালে আমরা ছয়জন পার্টনার মিলে একটি মুরগির খামার শুরু করলাম। ৫০০০ মুরগি। ভালোই চলছিল।

কিন্তু কিছুদিন পর মনে হলো আরো ভালো করা দরকার। খামারটা বড় করতে হবে। ব্যাংক থেকে নিলাম ৯০ লক্ষ টাকা সিসি লোন!

এখনো মনে পড়লে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। অল্প ক’দিনের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে কত বড় দুঃসাহস আমরা করেছিলাম!

মুরগি বাড়ল। ১৪০০০।

শতকরা ৯০টা মুরগিই ডিম দিচ্ছে। প্রতিদিন ১২৫০০ ডিম। মুরগির ডিমের চড়া বাজারে দিনে নীট মুনাফাই হতে লাগল ১২ হাজার টাকা।

কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। ভয়াবহ বার্ড ফ্লু দেখা দিল। মরে গেল খামারের সবকয়টি মুরগি।

সব হারিয়ে যখন শূন্য থেকে আবার শুরু করতে যাব, তখনই ব্যাংক পাঠাতে শুরু করল উকিল নোটিস।

আজ নোটিস, কাল চিঠি, পরশু পুলিশ।

শেষ পর্যন্ত বাধ্য হলাম অর্ধেক দামে খামারের জমি বিক্রি করে ব্যাংকের লোন শোধ করতে।

ঋণ তো শোধ হলো। কিন্তু আমরা হয়ে গেলাম দেউলিয়া। একদম কপর্দকশূন্য।

আজ এত বছর পরও সে ধকল সামলে উঠিতে পারি নি।

আজ বুঝি, ঋণ না করলে অন্তত এত খারাপ অবস্থা আমাদের হতো না!"

৫০ হাজার টাকার ওয়াশিং মেশিন দেড় লক্ষ টাকায়!

এই যে তরুণরা- এরা কেউ বিয়ের অপচয় করতে গিয়ে, কেউ ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে, কেউ ব্যবসা বড় করতে গিয়ে ঋণ করেছে এবং তারপর ঋণশোধ তো করতে পারেই নি, যা ছিল তাও খুইয়েছে!

কেন! কারণ ঋণের চক্রটাই এমন যে, তা কখনো শেষ হতে চায় না। মহাজনী ঋণ হোক বা ক্ষুদ্রঋণ, বন্ধকী ঋণ হোক বা ফ্ল্যাট-গাড়ির ঋণ – এসব কোনো ঋণেই ‘আসল’ সহসা শোধ হতে চায় না। বছরের পর বছর ধরে শুধু সুদ-ই গুণে যেতে হয়।  

ধরুন আপনি ৫০ হাজার টাকা দামের একটা ওয়াশিং মেশিন কিনলেন কিস্তিতে। ১০ বছরে ১২০ কিস্তিতে এটার দাম আপনাকে শোধ করতে হবে।

প্রথম মাসে দিতে হবে ১২১০ টাকা। আপনি কি জানেন, এর মধ্যে শুধু সুদই ১১৪৬ টাকা? ‘আসল’ মাত্র ৬৪ টাকা?  

দ্বিতীয় মাসে আপনি সুদ দেবেন ১১০৭ টাকা, আসল দেবেন ১০৩ টাকা। তৃতীয় মাসে সুদ ১১৪২ টাকা, আসল ৬৮ টাকা।

এভাবে ৯০ কিস্তি পর্যন্ত আপনি শুধু সুদই দিয়ে যাবেন। ১০ বছরে আপনার দেয় মোট সুদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৯৪৮৮৪.৭৫ টাকা।

অর্থাৎ ৫০ হাজার টাকার একটি ওয়াশিং মেশিন শেষ পর্যন্ত আপনি কিনছেন প্রায় দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে!

টার্গেট এখন বাংলাদেশ : বিসিজি-র ১০ পরামর্শ

এসব কারণেই পুঁজিবাদীদের নজর এখন উন্নয়নশীল দেশের দিকে। এসব দেশের মানুষকে কীভাবে ব্যাপকহারে ভোগ্যপণ্য ঋণীতে রূপান্তরিত করা যায় তার দিকে। আর বাংলাদেশ গণ্য হচ্ছে এ তালিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় টার্গেটে।

২০১৫ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ নামে বিশ্বখ্যাত কনসাল্টিং গ্রুপ বাংলাদেশকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে- Bangladesh: The Surging Consumer Market Nobody Saw Coming. এখানে তারা বাংলাদেশি ভোক্তাদের আচরণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নানাবিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে কয়েকটি অভিমত তুলে ধরে-

১. বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ভোক্তা বাজারগুলোর একটি। প্রতি বছর এদেশে ২০ লক্ষ এমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে যাদের বার্ষিক আয় ৫০০০ ডলার। বেশি আয় দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই তারা এমন সব জিনিস কেনার দিকে ঝুঁকবে জীবনযাত্রায় যা আরাম ও বিলাস যোগ করে। যেমন, এসি, বিদেশি শ্যাম্পু, কসমেটিক্স ইত্যাদি!

২. কিন্তু বাংলাদেশি ক্রেতারা ঋণ করে কিনতে চায় না। ঋণ করাকে সমাজে খারাপ চোখে দেখা হয় অথবা কীভাবে ঋণ করতে হয় সে সম্পর্কে জানা নেই-ইত্যাদি কারণে এদেশে ঋণ করে খুব কম মানুষই ভোগ্যপণ্য কেনে।

৩. বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই তরুণ এবং কর্মক্ষম। এদেশের মানুষের গড় বয়স হলো ২৪। আর ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা হিসেবে এ বয়োগোষ্ঠীই হলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময়।

৪. ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সচ্ছল ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১ কোটি ২০ লক্ষ থাকলেও ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ কোটি ৪০ লক্ষ। প্রবৃদ্ধির এই হার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর কোনো দেশেই নেই!

৫. বাংলাদেশিরা পৃথিবীর সবচেয়ে আশাবাদী ভোক্তা। বিসিজি যাদের ওপর জরিপ চালিয়েছে তাদের ৬০% ই বলেছে আগামী এক বছরে তাদের আয় বাড়বে বলে তারা আশা করে। অথচ আমেরিকার মাত্র ২৪ ভাগ ভোক্তা এরকম আশাবাদ দেখিয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ক্রেতারা মাত্র ১৮ ভাগ আর জাপানে এটা মাত্র ৯ ভাগ!

৬. বাংলাদেশের মানুষ ঋণকে ভয় পায়। বিসিজি যাদের ওপর জরিপ চালিয়েছে তাদের অর্ধেকই বলেছে যে, ঋণ যদি শোধ করতে না পারে তখন কী হবে- এ ভয়ে তারা ঋণ করতে চায় না!

৭. একই কারণে বাংলাদেশের মানুষ ক্রেডিট কার্ডও ব্যবহার করে খুব কম। বিসিজি দেখেছে সচ্ছল ও মধ্যবিত্তদের মাত্র ২০ ভাগ এবং সার্বিক ক্রেতাদের মাত্র ৬ ভাগ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে।

৮. গৃহঋণ নেয়ার প্রবণতাও বাংলাদেশিদের কম। বিসিজের জরিপে সচ্ছল ও মধ্যবিত্তদের মাত্র ৩ ভাগ গৃহঋণ নিয়েছে। বিসিজি আরো দেখেছে, ব্যাংক বা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের চেয়ে বাংলাদেশিরা আত্মীয়-বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে বেশি।   

৯. আর বিসিজি বাংলাদেশিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে বৈশিষ্ট্যটি খুঁজে পেয়েছে তাহলো বাংলাদেশিদের সঞ্চয় খুব কম। যেখানে ইন্দোনেশিয়ার শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষেরই কোনো না কোনো সঞ্চয় আছে, সেখানে বাংলাদেশিদের মাত্র ৫৮ ভাগ সঞ্চয় করে থাকে। ফলে সঞ্চয় নেই কিন্তু বাড়ি-গাড়ি বা বিলাসী পণ্যের প্রতি মোহ আছে- এমন বিপুল বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে বাকিতে পণ্য কেনায় আকৃষ্ট করা সম্ভব বলে বলছে বিসিজি।

১০. বাংলাদেশে ব্যবসা করে এমন সব প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাই বিসিজির পরামর্শ-বেশি বেশি পণ্য যেন তারা কিস্তিতে বিক্রির ব্যবস্থা করেন, ঋণসংক্রান্ত ক্রেতাদের ভয়-ভীতি দূরের উদ্যোগ নেন এবং বেশিসংখ্যক মানুষ যাতে ক্রেডিট কার্ডে কিনতে অভ্যস্ত হয় সেটা নিশ্চিত করেন।

কোরবানির মাংস রাখার জন্যে কিস্তিতে ফ্রিজ!

বোঝাই যাচ্ছে বিসিজি-র এসব পরামর্শ ব্যবসায়ীরা খুব গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে। কারণ ২০১৫ এর পর থেকেই দেশে হঠাৎ পণ্যঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের প্রচারণা খুব বেড়ে যায়।

বাড়তে বাড়তে আজ এমন অবস্থা যে কোরবানির মাংস রাখার ফ্রিজ পর্যন্ত বাকিতে কেনার প্রচারণা চালাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। অথচ কিস্তি বা সুদের মতো ‘হারাম’ জড়িত হয়ে যে পণ্য ঘরে ঢুকছে তাতে কোরবানির মতো পবিত্র উপলক্ষের মাংস রাখা কতটুকু ধর্মসিদ্ধ সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক!

প্রসঙ্গত বলা যায়, সংরক্ষণ সুবিধার সুযোগে আজকাল যেভাবে ফ্রিজবোঝাই করে বছরভর কোরবানির মাংস রেখে দেওয়া হয়, তা মোটেই ধর্মসিদ্ধ নয়। বরং ধর্মের নির্দেশ হচ্ছে- কোরবানির মাংস তিনদিনের মধ্যেই খেয়ে, বিতরণ করে এবং দরিদ্রকে দিয়ে শেষ করে ফেলা।

যে দেশগুলো ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছে তাদের কী পরিণতি?

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন পুঁজিপতিদের ঋণ প্রচারণার নব্য শিকার। কিন্তু এই প্রবণতা একটি দেশকে কোথায় নামাতে পারে তা বোঝা যাবে সেসব দেশকে দেখলে যারা ইতোমধ্যেই এই ঋণ অর্থনীতির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটিয়েছে।

২০১৬ সালে ওলফ স্ট্রিট একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে- ‘This is How Consumers Turn into Debt Slaves’. যেখানে তারা দেখায়- আয় সেভাবে না বাড়লেও লক্ষ লক্ষ আমেরিকান কীভাবে শিক্ষাঋণ, গাড়ির ঋণ আর ক্রেডিট কার্ডের ঋণের জালে আবদ্ধ হয়ে ঋণদাসে পরিণত হয়েছে। পরিমাণটা হলো ৩.৭১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, আমাদের টাকায় ৪ লক্ষ কোটি টাকা!

আর তার পরিণতি? দেশটির ৩ কোটি ৯৭ লক্ষ মানুষ এখন দারিদ্রসীমার নিচে অবস্থান করছে। ১৫ মিলিয়ন বা প্রতি ৫টি শিশুর ১টি শিশু সেখানে এমন দরিদ্র পরিবারে বাস করে যেখানে জীবনধারণের ন্যুনতম প্রয়োজনটুকুও মেটাবার ব্যবস্থা নেই।

ঋণকে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানীরা ‘সম্পর্কের ঘাতক’ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ অন্যান্য সম্পর্কের ক্ষতি করা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে বিয়েবিচ্ছেদের একটা প্রধান কারণ না কি এই ঋণ। 

বৃটেন। বিশ্বজুড়ে একসময় এর উপনিবেশ এত বিস্তৃত ছিল যে বলা হতো ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য ডোবে না’। মানে ভূখণ্ড এত ব্যাপক যে কোথাও না কোথাও দিন থাকেই। সেই বৃটেন বা যুক্তরাজ্যের ১২ শতাংশ লোক এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কারণ ক্রেডিট কার্ড। সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ইংল্যান্ডে প্রতি বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ ঋণের ধকল সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

Debt Slave : ঋণদাস

ওলফ স্ট্রিট ‘Debt Slave’ শব্দটি যথার্থই উদ্ধৃত করেছে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ঋণদাস’। একজন মানুষ যখন ঋণগ্রস্ত হয়, সে আসলে তখন একজন ‘দাসে’ পরিণত হয়। ঋণশোধের চিন্তা ছাড়া তার মাথায় আর কিছু থাকে না।

এমনকি এজন্যে অনেক সময় সে অন্যায়, অনৈতিক পথেও পা বাড়িয়ে দেয়। কারণ পাওনাদারের কাছে অপমানিত হওয়ার চেয়ে অন্যায়পথে দ্রুত কিছু হাসিল করে মুক্ত হওয়াকেই তার শ্রেয় মনে হয়।  

আর তা না পারলে সে আশ্রয় নেয় মিথ্যা, ওয়াদা খেলাফের। এ কারণেই যে সমাজে ঋণগ্রস্ততা বেশি, সে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ও বেশি। মিথ্যা, অসততা, অপরাধ বেশি!

ঋণদাস : নেপালের ঘটনা

ঋণ যে আক্ষরিকভাবেও মানুষকে দাসে পরিণত করে তার ইতিহাসও হাজার বছরের। আগেকার দিনে মহাজনরা যাদেরকে ঋণ দিতেন, গরিব সেই মানুষগুলোকে ঋণশোধ না হওয়া পর্যন্ত মহাজনের বাড়িতে পেটেভাতে কাজ করতে হতো। এমনকি ঋণশোধ না হলে বংশানুক্রমেও। মানে বাবার মৃত্যুর পর ছেলেকে, ছেলের মৃত্যুর পর নাতিকে, নাতির মৃত্যুর পর পুতিকে।

আবার নেপালের নিম্নবর্ণের হিন্দুদের শিকার হতে হতো এক নিষ্ঠুর সংস্কৃতির। সেখানে মেয়ের বিয়ের সময় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিতে হতো নিম্নবর্ণের হিন্দুদের। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির বদলে মেয়েকে চলে যেতে হতো মহাজনের বাড়িতে।

মহাজন তাকে নিজের যৌনদাসী হিসেবেও রাখতে পারে আবার পতিতালয়েও পাঠিয়ে দিতে পারে। এভাবে একবছর দুবছর পর মহাজন যখন মনে করবে তার পাওনা শোধ হয়েছে, তখনই মেয়েটি মুক্তি পাবে। যেতে পারবে সে তার শ্বশুরবাড়িতে সংসার করার জন্যে।

ঋণের ব্যাপারে ধর্ম

সনাতন

এসব কারণেই প্রত্যেক ধর্মই ঋণকে নিরুৎসাহিত এবং নিষিদ্ধ করেছে। সনাতন ধর্মে বলা হয়েছে- ইহলোকে উত্তমর্ণের কাছে সকল ঋণশোধ করার শক্তি দাও। তোমার প্রাসাদে আমায় সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। ঋণ নিমিত্ত নরকপাত থেকে আমায় মুক্ত করো। [অথর্ববেদ : শ্লোক ১১৭-১৮-১৯]

খ্রিষ্টীয় সাধক

খ্রিষ্টীয় সাধক সেইন্ট বাসিল ঋণখাতকের (দেনাদার) দুরবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে ৩৬৫ খ্রিষ্টাব্দে লেখেন- প্রত্যেক দিন এবং রাত খাতকের জন্যে একটা দুঃসহ যন্ত্রণা! তার জীবন হয়ে যায় নিদ্রাহীন এবং একটা অনিশ্চয়তায় সে সবসময় ভুগতে থাকে। যখন মানুষের সামনে যায় সে লাঞ্ছিত হয়। যখন সে ঘরে থাকে তখন চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকে এবং দরজায় প্রত্যেক অপ্রত্যাশিত করাঘাতে সে চমকে ওঠে- এই বুঝি পাওনাদার এল। রাতে তার ঘুম ভেঙে যায় দুঃস্বপ্নে যে পাওনাদার বোধ হয় তার বালিশের পাশেই এসে দাঁড়িয়েছে।

সেইন্ট অ্যামব্রোস ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে লিখেছেন মিলানের ঘটনা- ঋণগ্রস্ত পিতারা বাধ্য হচ্ছেন তাদের সন্তানদের কৃতদাস হিসেবে বিক্রি করে দিতে। ঋণী লজ্জায় আত্মহত্যা করছে। সুদি ব্যবসা বা ঋণী ব্যবসা হলো ডাকাতি, এমনকি খুনের সাথেও তুলনীয়।

ইসলাম

আর ইসলামে তো সুদি ব্যবসাকে 'হারাম' বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মহানবী (স) যেভাবে ঋণকে নিরুৎসাহিত করেছেন, সতর্ক করেছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য-

হে আল্লাহ! আমি কুফর বা সত্য অস্বীকার এবং ঋণ থেকে তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি। একজন প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি কুফর আর ঋণকে এককাতারে ফেলছেন? নবীজী (স) বললেন, হাঁ আমি কুফর এবং ঋণকে একসাথেই উল্লেখ করছি। কারণ ক্ষতিকর বিবেচনায় দুটিই সমান।

আরেকটি হাদিস আয়েশা (রা) বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (স) অধিকাংশ সময় ঋণ এবং পাপ হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। আমি বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ আপনি কত বেশিই না ঋণ হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে থাকেন। তখন তিনি বললেন যে ব্যক্তি ঋণী হয়, সে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে; যখন ওয়াদা করে, তা ভঙ্গ করে।

ওআইসি এবং ক্রেডিট কার্ড

২০০০ সালে ওআইসি বা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স একটি রেজ্যুলুশন প্রকাশ করে। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের ইসলামী বিশেষজ্ঞদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে ফতোয়া-

Resolved that the conventional Credit Card is not permissible in Islam if its conditions involve imposition of interest, even if the intention of then cardholder is to repay within the monitorial period that precedes imposition of interest. (Resolution No 108/2/12)

অর্থাৎ, যে ক্রেডিট কার্ডে সুদ থাকে ইসলামে তা অনুমোদিত নয়। এমনকি কার্ডগ্রহীতা যদি সুদ আরোপের আগে তা পরিশোধও করে ফেলেন, তারপরও নয়।  

তাহলে করণীয়-

ব্যবসা বাড়াবার নামে

ব্যবসা বাড়াবার নামে ব্যাংকলোনের ফাঁদে পড়বেন না। শেষে ব্যবসা যাবে, লোনও শোধ করতে পারবেন না। হয় ব্যাংক আপনার বন্ধক নিয়ে যাবে। নয়তো ঋণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ সম্পদ বিক্রি করে শোধ করতে হবে ‘লোন’।   

ঋণ করে বাড়ি/ফ্ল্যাট

ঋণ করে বাড়ি বানাবেন না। ফ্ল্যাট কিনবেন না। বছরের পর বছর কিস্তি দিয়েও দেখবেন ‘আসল’ বাকিই পড়ে আছে। ঋণ করে বাড়ি বানাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন, দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন- এমন বহু ঘটনা আছে।

উপার্জন করুন তারপর কিনুন

ঋণ করে ভোগ্যপণ্য কিনবেন না। উপার্জন করুন, তারপর কিনুন। ঋণ করে কেনা আসলে আত্মমর্যাদাবোধেরই চরম অবমাননা- প্রমাণ করে নগদে নিজের টাকায় কেনার যোগ্যতা আপনার নেই।     

ক্রেডিট কার্ডকে 'না' বলুন 

ক্রেডিট কার্ডকে ‘না’ বলুন। নগদে কেনার সামর্থ্য যখন অর্জন করবেন, তখন কিনুন। তার আগে যত চাপই থাকুক, যত প্রয়োজনই হোক, ধৈর্য ধরুন। অপেক্ষা করুন। সামর্থ্য আপনার হবেই।    

অহেতুক পণ্য কেনার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসুন

কিছু কেনার আগে তিনটি প্রশ্ন করুন নিজেকে - Do I need it? আমার কি এটা প্রয়োজন? Do I need it now? এখনই কি প্রয়োজন?

দুটো প্রশ্নের উত্তরই যদি ‘না’ হয়, তাহলে জিজ্ঞেস করুন তৃতীয় প্রশ্ন- Can I do without it? এটা ছাড়াও আমার চলবে কি না?

যদি এর উত্তরও ‘না’ হয়, তাহলে বুঝবেন এটি আপনার জন্যে একটি অপ্রয়োজনীয় ক্রয়। প্রয়োজন নয়, বরং ঝোঁকের বশে আপনি এটা কিনতে চাইছেন।

আসলে ‘স্ট্যাটাস’ বাড়াবার জন্যে অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক পণ্য কেনার অস্থিরতা মানসিক অসুস্থতারই প্রকাশ! এ প্রতিযোগিতা আপনাকে কখনো শান্তি দেবে না।

ক্ষুদ্র ও মহাজনী ঋণ

ক্ষুদ্রঋণ ও মহাজনী ঋণকে ‘নিষিদ্ধ’ মনে করবেন। এসব ঋণের সুদের হার কখনো কখনো শতকরা ২৬ থেকে ৩৬ ভাগ পর্যন্ত হয়ে থাকে। আপনি কোনোদিনই এসব ঋণের জাল থেকে বেরুতে পারবেন না।

ঋণস্বভাবীদের এড়িয়ে চলুন

পরিজন ও পরিচিতদের মধ্যে ঋণ-স্বভাবের কেউ থাকলে তাকে এড়িয়ে চলুন। ধার দেয়া বা তার হয়ে ধার নেয়ার ভুল করবেন না। মারাত্মক খেসারত দিতে হতে পারে।

গ্যারান্টর হবেন না

কারো ঋণের গ্যারান্টর হবেন না। দোষ না করেও ঋণীর ব্যর্থতার দায় চাপতে পারে আপনার ঘাড়ে। বিপন্ন হতে পারে আপনার সম্পদ, সম্মান, শান্তি।    

প্রার্থনা করুন, পরিচিতদেরও বলুন

ঋণের অভিশাপ থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর রাসুল (স) যে প্রার্থনা নিজে করতেন, সে প্রার্থনা আপনিও করুন-‘আউযুবিল্লাহি মিনাল কুফরি ওয়াদ্দাইন’। হে আল্লাহ! আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি কুফর থেকে এবং ঋণ থেকে। এমনকি পরিচিতদের, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দেরও বলতে পারেন এ প্রার্থনা করতে। হয়তো তারাও সচেতন হয়ে উঠবেন ঋণের ক্ষতি সম্পর্কে।    

উপসংহার

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন গত ২৭ বছর ধরে ঋণের ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে আসছে। বলছে ঋণ থেকে মুক্ত থাকতে। এমনকি ফাউন্ডেশনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতেও কোথাও কোনো ঋণের ছোঁয়া নেই।

বহুমুখী সেবা প্রকল্পগুলোর প্রতিটিই ঋণমুক্ত, বিদেশি সাহায্যমুক্ত, নিজেদের অর্থায়নে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে কার্যক্রমগুলোর সমৃদ্ধি ও বরকতও দৃশ্যমান।

আসুন ঋণ, কিস্তি ও ক্রেডিট কার্ডের অভিশাপ থেকে নিজেরা বাঁচি। অন্যদের বাঁচাই। গড়ে তুলি সচ্ছল, সম্মানিত জীবন। কারণ ঋণমুক্ত সচ্ছল, সম্মানের জীবনই প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।

[সজ্ঞা জালালি,  আগস্ট, ২০১৯ অবলম্বনে]