কবি শামসুর রহমান বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন- ‘হঠাৎ আকাশ সাদা মুখটি কালো করে, কালো মেঘে বুকটি ফুঁড়ে পানি পড়ে, ঝর ঝর ঝর একটানা বৃষ্টি ঝরে, বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি ঝরে’। ধরুন এমনি কোন এক ঘনঘোর বর্ষার দিনে আপনার সামনে মাখানো কাঁচা লংকা, পেঁয়াজ, মুড়ি আর আপনার হাতে আপনার সেই প্রিয় বইটিতে নাক ডুবিয়ে পড়তে পড়তে হারিয়ে যাচ্ছেন অন্য কোনো এক রাজ্যে। এমনটি শেষ কবে ঘটেছে মনে করুন তো! কিংবা, সারাদিনের ছোট-ছোট দৌড়-দৌড় ব্যাস্ততার পর রাতে ঘুমাতে যাবার সময় মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ না রেখে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে শেষ কবে গভীর ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেছেন!
আপনি বলতে পারেন, এখন আমাদের জীবন অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠেছে- ইন্টারনেটের কল্যাণে অফুরন্ত তথ্যভাণ্ডার আমাদের সামনে উন্মুক্ত হয়ে পরেছে। ফলে বই ঘেঁটে বিস্তারিত তথ্য জানার প্রয়োজনটা কি? কম সময়ে অল্প পরিশ্রমে প্রয়োজনীয় তথ্যটা তো পেয়েই যাচ্ছি।
আসলেই কি তাই? মেনে নিচ্ছি প্রযুক্তির কল্যাণে অফুরন্ত তথ্যভাণ্ডার আমাদের সামনে। কিন্তু আপনি কি জানেন, বই পড়ার অভ্যাস আপনার মস্তিষ্কর কাঠামোকে বদলে দিতে পারে?
সম্প্রতি মার্কিন গবেষকরা বলেছেন, একটি উপভোগ্য বই পড়ার পর মানুষের মস্তিষ্কের বাস্তব ও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টার এমোরি ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা বলেন, একটি উপন্যাস পড়ার ফলে পাঠকের মস্তিষ্কের ‘রেস্টিং স্টেট’ এ পরিবর্তন ঘটে এবং তা বেশ কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে।
সত্যজিৎ রায়ের ‘’রতনবাবু আর সেই লোকটা’’ ছোট গল্পটি শুরু হয়েছে ঠিক এভাবে - ট্রেন থেকে প্লাটফর্মে নেমে এদিক ওদিক দেখে রতনবাবুর মনে একটা খুশির ভাব জেগে উঠল। জায়গাটা তো ভালো বলেই মনে হচ্ছে। স্টেশনের পিছনে শিরীষ গাছটা কেমন মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, তার ডালে একটা লাল ঘুড়ি আটকে রয়েছে। লোকজনের মধ্যে বাস্ততার ভাব নেই, বাতাসে কেমন একটা সোঁদা গন্ধ- সব মিলিয়ে দিব্যি মনোরম পরিবেশ।
আপনি দেখুন, লেখাটি পড়তে পড়তে আপনার চোখের সামনে দিব্যি ভেসে এলো একটা ট্রেন, প্লাটফর্ম, শিরীষ গাছটার মাথা উঁচু করে জেগে থাকা, লাল ঘুড়িটা এমনকি বাতাসের সোঁদা গন্ধ। আপনি সেখানে বাস্তবে যাননি বটে কিন্তু কি অবলীলায় দৃশ্যপটটি আপনার মতো করে কল্পনা করে নিলেন! এতে আপনার ব্রেনের একটি নিউরনের সাথে আরেকটি নিউরনের যোগাযোগ বাড়ল, ব্রেন সেলের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটলো।
বই পড়ে মস্তিষ্ককে শান দেয়া যায়, বিভিন্ন জিনিস জানা যায় এবং সেই অনুপাতে চিন্তা করার ক্ষমতাও অর্জন করা যায়। একটি ভালো বই কেবল তথ্য এবং প্রশ্নের উত্তরই কেবল দেয় না। সেই সাথে নতুন নতুন প্রশ্ন করতে শেখায়, চিন্তা করতে শেখায়। একটি বই ধারণ করে একটি ঘটনা, একটি পরিস্থিতি এবং একটি পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে এবং সেখানে কাহিনীর ভেতর দিয়ে চরিত্রগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ইতিবাচক ও নেতিবাচক ফলাফলকেও তুলে ধরে।
যুক্তরাষ্ট্রের টাফট’স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যারিয়্যান উলফ বলেছেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কের যে আদি গঠন, তাতে এমন কোনো সক্ষমতা ছিল না যে লিখিত শব্দ বা বাক্য পড়ে সে তার অর্থ বুঝবে। মানুষ যখন থেকে পড়তে ও লিখতে শিখেছে, তখন থেকে তার মস্তিষ্কে এক নতুন ধরনের পরিবর্তনের সূচনা ঘটেছে।’ ম্যারিয়্যান আরও বলেছেন, ‘মানুষ ‘রিডিং ব্রেইন’ এর অধিকারী হয়েছে। পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে আর কারোরই এই মস্তিষ্ক নেই, যা গড়ে উঠেছে কেবল পড়তে পড়তেই। পড়ার সময় মানুষের মস্তিষ্কে যেসব জ্ঞানীয় ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া হয়, ছবি দেখা ও শব্দ শোনার ফলে তা হয় না।’
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষক ও অধ্যাপক এনি ই কামিংস তার ‘হোয়াট রিডিং ডাস ফর দ্য মাইন্ড’ নামক গবেষণাপত্রে বলেছেন, বই পড়া স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে স্মার্ট করে, বয়স কমিয়ে দেয়। যে কোনো বয়সে যে কোনো বই পড়াই একজন মানুষকে উন্নতি আর সুখ দেয়। তার গবেষণা বলছে, যারা অধিক জিপিএপ্রাপ্ত তারা নিজের পাঠ্যতালিকার বাইরেও নিয়মিত বই পড়েন।
বিজ্ঞানী কিংবা ধনকুবের, প্রোগ্রামার কিংবা প্রকৌশলী, ব্যাংকার কিংবা প্রকৌশলী—পৃথিবীর প্রায় সব সফল মানুষের মধ্যে একটাই সহজ মিল, তারা সবাই বই পড়তেন, পড়ছেন এবং ভবিষ্যতে পড়বেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনকুবেরদেরও এক নম্বর হবি হচ্ছে বইপড়া। আব্রাহাম লিংকন, ওয়ারেন বাফেট, টমাস আলভা এডিসন কিংবা মহাত্মা গান্ধী—সবারই জেগে থাকা সময়ের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন বই পড়ে।
যে অন্তর্দৃষ্টির জন্য বিল গেটস কম্পিউটারের ভবিষ্যৎ দেখতে পান, জামিলুর রেজা চৌধুরী হয়ে ওঠেন অগ্রগণ্য প্রকৌশলী, আতাউল করিম তৈরি করেন ম্যাগলেভ ট্রেন—সে অন্তর্দৃষ্টির পুরোটাই তৈরি হয় এই বই পড়ার মাধ্যমে। বই পড়া আমাদের যে শক্তি দেয়, সেটি বদলে দিতে পারে এই জগতটাকে। এই জন্যই মাও সে তুং বলে গেছেন—পড়, পড় এবং পড়।
স্কুলে পড়ার সময় থেকে বিল গেটস এর মূল আগ্রহ ছিল তথাকথিত ‘আউটবই’ পড়া। কাজের পাশাপাশি যা কিছু পড়ে ফেলায় অভ্যাস, সেটি পত্রিকা, ম্যাগাজিন কিংবা বই যাই হোক না কেন, বিল গেটসের সামনে একটা নতুন জগৎ উন্মোচিত করে। তার এত সাফল্যের রহস্য কী জানতে চাইলে বিল গেটসের উত্তর একটাই- বই পড়া। প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসেন তিনি। আর তাই তার জীবনে সকল উন্নতির পিছে বই পড়া একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তিনি। বিল গেটস বলেছেন, “আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার নানা ধরনের স্বপ্নের পেছনে একটা বড় কারণ ছিল বই পড়া। বৈচিত্র্যময় বই পড়ার কারণেই আমি অনেক স্বপ্ন দেখতাম।”
সফল মার্কিন ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট বলেছেন, ‘আমি কেবল অফিসে গিয়ে বসি আর সারাদিন পড়াশোনা করি।’ তিনি রীতিমতো হিসাব-নিকাশ করে বের করেছেন যে তার কাজের দিনগুলোর শতকরা ৮০ ভাগ তিনি ব্যয় করেন পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা করে।
রকেট নির্মাণপ্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ককে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, আপনি কিভাবে রকেট তৈরি করলেন? উত্তরে তিনি বললেন, বই পড়ে। ইলনের বয়স যখন নয় বছর, তখন তিনি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পুরোটা পড়ে ফেলেছিলেন! সে সময় বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পড়তে গড়ে ১০ ঘণ্টা সময় তিনি ব্যয় করতেন। আজ সেই মানুষটির হাত ধরেই মঙ্গলে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে মানুষ। ভার্জ ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার ছোট্ট লাইব্রেরিতে মহাকাশ-সম্পর্কিত যত বই আছে, তার সবকটি আমি পড়েছি।’
ব্যতিক্রম আমাদের দেশেও নেই! জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কথাই ধরা যাক! আমাদের অভিভাবকসম দেশের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম এই শীর্ষ প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ নিয়মিত বই পড়তেন। পঞ্চাশের দশকে এসএসসি পরীক্ষায় পর প্রতিদিনই তিনি সদ্য চালু হওয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি) সকালে চলে যেতেন, দুপুরে বাসায় খেতে এসে আবার লাইব্রেরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই বই পড়তেন। ছোটবেলা থেকে যেকোনো বিষয়ের বই তিনি পড়তেন। বুয়েটে শিক্ষাকালীন প্রতিদিন ক্লাস থেকে চলে যেতেন ব্রিটিশ কাউন্সিলে, কোনো কোনো দিন ইউএসআইডি লাইব্রেরি। তরুণদের জন্য স্যারের আপ্তবাক্য—‘পড়ার সময় এখনই। বিষয় নিয়ে ভাবার দরকার নেই। শুধু পড়তে থাকো।’
মায়ের মুখে গল্প শোনার সময় শিশুরা মনে মনে কল্পনার জাল বোনে। বই মানুষের কল্পনাশক্তিকে উজ্জীবিত করার পাশাপাশি মনের ভিতর নিজের একটি জগৎ তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের সংস্পর্শে এবং বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুদের সহজে ভাষা শেখা ও স্কুলে সাফল্যের একটা গভীর সংযোগ রয়েছে। বই মানুষের মধ্যে মমতা, বিনয় ও সৃজনশীলতার বিকাশে সাহায্য করে। এসব কারণে বই পড়া খুব জরুরি। আর আধুনিক যুগ যন্ত্রণায় সন্তানদের হাতে স্মার্টফোনের বদলে বই তুলে দেওয়া আরো বেশি জরুরি।
মানুষের জীবনে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় বই পড়ার সময় বা সুযোগ কমে যাচ্ছে। শিশুরা বড় হওয়ার সময় বইয়ের চেয়ে স্মার্টফোনের ছোঁয়া পাচ্ছে বেশি। এর ফলেও নতুন প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ কম। এজন্যে ছোট থেকেই শিশুদের বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া জরুরি। অনেকের কাছেই এখন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়া ব্যাপারটা শুধুই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও অনলাইনে কিছু পত্র-পত্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এই ঝোঁকের পরিণতি খুব ভালো নয়। মানুষের আচার-আচরণেও এর প্রভাব পড়ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেঘলা সরকার জানান, সুস্থ মানসিকতার জন্য বই পড়া জরুরি। মানুষের সৃজনশীল ও মননশীল হওয়ার মতো গুণাবলি বিকাশে বই পাঠ খুব কাজের। বই পড়ে যে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায় তা অন্য কিছুতে সম্ভব নয়। পাঠের মাধ্যমেই মানুষের কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে সবচেয়ে বেশি। এ জন্য ছোট থেকেই শিশুর মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে দিতে হবে অভিভাবককেই। কারণ শৈশবই ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম পর্ব। শুরুতে শিশুকে বড় বড় ছবিযুক্ত বই, মজার ছড়ার বই ও কমিকসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারেন। বড় হতে হতে বয়স বুঝে বই বেছে দিন। একবার বই পড়ার মজা পেয়ে গেলে একদিন নিজ থেকেই বই পড়তে শুরু করবে।
বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে প্রতিদিন পড়ার চেষ্টা একবার করেই দেখুন না! হোক না কয়েক পাতা, তবু পড়ুন। এরপর ধীরে ধীরে পড়ার পরিধি বাড়াতে পারেন। এ ছাড়া যে বই ভালো লাগে সে বই দিয়েই পড়া শুরু করতে পারেন। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় শুধু বই পড়ার জন্য ঠিক করতে পারেন। এ ছাড়া রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে পারেন। এভাবেই ধীরে ধীরে পাঠের অভ্যাস তৈরি করতে পারেন।
কাল সচেতন লেখক প্রমথ চৌধুরী তার ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে নানান যুক্তি প্রমাণের মাধ্যমে বই পড়ার প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। একজন শিক্ষার্থীকে মননশীল ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই তাকে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই, নিয়মিত পত্রিকা পড়তে হবে। জানার পরিধি বাড়াতে হবে।
কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হয়, বই পড়ার অভ্যাসটা কমে গেছে। এটা সত্যি। বই একটি ভিন্নমাত্রার জিনিস। এর মাঝে আনন্দ, শিক্ষা ও জীবনকে গড়ে তোলার স্বপ্নময় জগৎ আছে। তাই তরুণ ও শিশুদের বইমুখী হতে হবে। এই চর্চাটা পারিবারিকভাবে হওয়াটাই জরুরি।
শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিনির্ভরতা আর মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয় বিস্তর। সন্তানদের মোবাইল আসক্তি নিয়ে অভিযোগ প্রায় প্রতিটি মা-বাবার। কিন্তু এদিকে মা-বাবাই যে মোবাইল আসক্তিতে তলিয়ে যাচ্ছে সেই খবর কি আমরা রাখি? আমরা শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গঠন নিয়ে চিন্তিত, চিন্তিত শিশুদের সুস্থ বিনোদনের চর্চা নিয়ে। অথচ বই পড়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আমরা যে প্রজন্মটি বেড়ে উঠেছিলাম, সেই প্রজন্মটি বই পড়া ভুলতে বসেছি প্রায়।
সৈয়দ মুজতবা আলীর বই কেনা প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন আনাতোল ফ্রাঁসের কথা। আনাতোল ফ্রাঁস বলেছিলেন, ‘মনের চোখ বাড়ানো-কমানো তো সম্পূর্ণ আমার হাতে। নানা জ্ঞান-বিজ্ঞান যতই আমি আয়ত্ত করতে থাকি, ততই এক-একটা করে আমার মনের চোখ ফুটতে থাকে।’ অর্থাৎ অন্তর্দৃষ্টি বাড়াবার পন্থা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন বই পড়ার কথা।
যে বয়সে শিশু–কিশোরেরা মাঠে-ঘাটে খেলে বেড়ায়, সেই বয়সে আরবের রিতাজ আলহাজমি নামের একটি কিশোরী মাত্র ১২ বছর বয়সেই দুটি বেস্টসেলার উপন্যাস লিখে গিনেস ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ডসে নাম লিখিয়েছে ২০২১ সালে। রিতাজ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী বেস্টসেলার লেখক। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হলো? ছোটবেলা থেকেই গল্প-উপন্যাস পড়তে পড়তে বড় হয়েছে রিতাজ। ছোটবেলা থেকেই তার বাবা তাকে বিভিন্ন ধরনের বই কিনে দিতেন, আর আগ্রহ নিয়ে সেসব বই পড়ে ফেলত রিতাজ। একদিন রিতাজের বাবা একটি বুকসপের বুকশেল্ফের দিকে তাকিয়ে বললেন, রিতাজ তুমি স্বপ্ন দেখো, একদিন তোমার লেখা বই এখানে থাকবে আর তাতে জ্বলজ্বল করছে তোমার নাম। স্বপ্ন পূরণে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি রিতাজকে। ট্রেজার অব দ্য লস্ট সি নামে ২০১৮ সালে প্রকাশিত রিতাজের প্রথম বইটি বেস্টসেলার হলো। তার দ্বিতীয় বেস্টসেলার বইটি পোর্টাল অব দ্য হিডেন ওয়ার্ল্ড প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। আর এখন রিতাজের একটাই স্বপ্ন, লিটরেচারে নোবেল প্রাইজ পাওয়া। ভাগ্যিস রিতাজের বাবা স্মার্ট ফোনের বদলে তার হাতে বই তুলে দিয়েছিলেন, তাকে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন!
বই পড়ে জ্ঞানের ভুবনে বিচরণ করলে বিপথগামিতা থেকে রক্ষা পেতেও সাহায্য করে। ২০১৫ সেপ্টেম্বরে বিবিসি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়, ইরানের একটি আদালতের বিচারক কাশেম নাকিজাদেহ একজন আসামীর সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারণ করেন বই কেনা ও বই পড়ায়। বিচারকের ভাষ্য মতে নিয়মিত বই পড়া আসামীকে ধীরে ধীরে একজন ভালো মানুষে রূপান্তর করতে পারবে। কারণ সঠিকভাবে বই পড়া একজন মানুষ সহজে মন্দ কাজ করতে পারেন না। তাই একজন ভালো মানুষ হতে হলেও বই পড়তে হবে। বই পড়ে জ্ঞান অন্বেষণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাঝে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সত্য ও সুন্দরের বার্তা, জাগ্রত হয় মমত্ববোধ, সৃষ্টি হয় সম্প্রীতির ভাবনা।
পাঠ্যবইয়ের ভেতর গল্পের বই লুকিয়ে রাখা, টর্চের আলোয় রাত জেগে বুঁদ হয়ে পড়তে পড়তে মায়ের বকুনি খাওয়া কিংবা ক্লাসে শিক্ষকের চোখের আড়ালে পছন্দের বই পড়ে কানমলা খাওয়া প্রজন্ম এখনো কিন্তু অতীত নয় ! আইফোন, আইপ্যাড, ওয়াইফাই, ব্লুটুথের ভিড়ে বই পড়াটা যেন হারিয়ে না-যায়। সভ্যতার গতিময় রিলে-রেসের কাঠিটা আমরা এক যুগ থেকে আরেক যুগে কি আবলিলায় আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আর এই কাঠিটা হলো বই।
কথায় বলে, একজন বইপ্রেমী কখনো একা ঘুমোতে যান না। তার বুকের উপর একটা বই থাকে, বইয়ের ভেতরে অসংখ্য চরিত্র থাকে, আর তাতে থাকে নতুন একটি জগত। তাহলে আজ থেকেই শুরু হোক বইপড়া। মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ না রেখে আসুন না, প্রিয় বইয়ের পাতাটি ছুঁয়ে আগামী দিনের সুন্দর স্বপ্ন দেখতে দেখতে প্রিয় বইটি বুকে জড়িয়ে গভীর আনন্দে অবগাহন করতে করতে ঘুমিয়ে পরি, আরেকটি নতুন দিনের প্রত্যাশায়।