স্যালাইন খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হোন; নইলে ঘটতে পারে বিপদ

এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুঁড় আর আধা সের পানি- তিনে মিলে খাবার স্যালাইন। কিন্তু আধুনিক ব্যস্ত জীবনে এতকিছু আয়োজনের সময় কোথায়! হাতের কাছে আছে তাই খাবার স্যালাইনের প্যাকেট।

ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় পানি ও লবণ কমতে থাকে। ঘাটতি দেখা দেয় পটাশিয়ামেরও। এসব ঘাটতি সরাসরি পূরণ করে দেয় খাবার স্যালাইন। 

তবে জীবন বাঁচাতে কার্যকরী এই জিনিসটিই হতে পারে প্রাণঘাতী যদি তা নিয়ম মেনে প্রস্তুত করা না হয়। 

অথচ এ ব্যাপারে সচেতন নন অনেক শিক্ষিত মানুষও

ঢাকার এক পরিচিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মুনিরা (ছদ্মনাম)। দেড় বছরের শিশুসন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে তিনি তাকে খাবার স্যালাইন খাওয়াতে শুরু করেন। কিন্তু সুস্থ হওয়ার বদলে শিশুটি শকে চলে যায়, আইসিইতে নিতে হয় তাকে। জীবন-মরণ অবস্থা!

ডাক্তার জানান, শিশুটির এই অবস্থার জন্যে দায়ী ভুল পদ্ধতিতে স্যালাইন প্রয়োগ।

এক প্যাকেট স্যালাইন আধা লিটার পানিতে গুলিয়ে খাওয়ানোর নিয়ম থাকলেও শিশুটিকে খাওয়ানো হয়েছিল মাত্র ১০০ মিলিলিটার পানিতে গুলিয়ে! ৩ দিনে এভাবে মোট ১২ প্যাকেট স্যালাইন খাওয়ানো হয় তাকে। আর তাতেই শিশুটির এমন দশা।

ডায়রিয়ায় শিশুমৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ভুল স্যালাইন থেরাপি 

অনেকেই মনে করেন ঘন ঘন পাতলা পায়খানায় অল্প পানিতে ঘন করে স্যালাইন গুলিয়ে খাওয়ালেই বুঝি রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। মারাত্মক ভুল ধারণা!

ডায়রিয়ায় ভুল মাত্রা বা ভুল পদ্ধতিতে স্যালাইন খাওয়ালে রোগীর অবস্থা ভালোর চেয়ে খারাপই হয় বেশি। বিশেষত শিশুরা পড়ে যায় মারাত্মক ঝুঁকিতে।  

২০১৮ সালে ভুল স্যালাইন থেরাপির শিকার হয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয় চল্লিশের বেশি শিশু, যাদের বেশিরভাগই মারা যায়।   

স্যালাইন বানানো ও খাওয়ানোর ক্ষেত্রে যে ভুলগুলো করবেন না

১. কম-বেশি পানিতে স্যালাইন বানানো

ওরস্যালাইনের প্যাকেটে যে গুঁড়ো থাকে তার উপাদানগুলো হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, এনহাইড্রাস গ্লুকোজ এবং ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট ডাইহাইড্রেট নামক লবণ। স্যালাইনের প্যাকেটে এই উপাদানগুলো এমনভাবে থাকে যেন তা আমাদের শরীরের ঘনত্বের সাথে মিলে যায়। একে আইসটনিক দ্রবণ বলে। এর ফলে শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ হয়। 

অল্প পানিতে বেশি ঘন করে স্যালাইন বানালে তা হাইপারটনিক হয়ে যাবে। অর্থাৎ, স্যালাইনের ঘনত্ব শরীরের ভেতরের তরলের ঘনত্বের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। এই ঘন স্যালাইন খেলে কোষের ভেতরের পানি সমতার জন্য কোষের বাইরে চলে আসবে। এতে শরীর আরও পানি হারাতে থাকবে এবং পানিশূন্যতা আরও বেড়ে যাবে। এর ফলে এমনকি রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। 

অন্যদিকে, পরিমাণের চেয়ে বেশি পানিতে স্যালাইন তৈরি করলে এই দ্রবণ হয়ে যাবে হাইপোটনিক, যার ঘনত্ব শরীরের তরলের ঘনত্বের চেয়ে কম। ফলে সমতার জন্য লবণ বাইরে রেখে বেশি বেশি পানি কোষে চলে যাবে। এতে কোষ ফুলে উঠে নষ্টও হয়ে যেতে পারে। 

২. অল্প অল্প করে স্যালাইন বানানো

এক প্যাকেটের পুরোটা দিয়ে স্যালাইন বানিয়ে ১২ ঘন্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যায়। ১২ ঘন্টা পেরিয়ে গেলে অবশিষ্ট স্যালাইন ফেলে দিতে হয়। তাই অপচয় রোধে কেউ কেউ অল্প অল্প স্যালাইন গুঁড়ো দিয়ে কয়েকবারে স্যালাইন বানান।

এটাও ভুল পদ্ধতি! কারণ এভাবে ভাগে ভাগে স্যালাইন বানালে গুঁড়ো ও পানির অনুপাত ঠিক থাকবে না। এতে উপকারের বদলে ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি থাকে। 

৩. বেশি বেশি স্যালাইন খাওয়া

অনেককেই দেখা যায় একটু ঘামলে বা কাজ করে ক্লান্ত হলেই স্যালাইন খেয়ে নেন। দিনে ২/৩ প্যাকেট স্যালাইনও অনেককেই খেতে দেখা যায়। 

অতিরিক্ত স্যালাইন খেলে রক্তে বাড়তি সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশে ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্যহীনতা তৈরি করতে পারে। রক্তে লবণের পরিমাণ বেড়ে হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যাও বাড়িয়ে দিতে পারে। 

৪. ঠান্ডা বা গরম পানিতে স্যালাইন বানানো

খাবার স্যালাইন বানাতে হবে কক্ষতাপমাত্রার পানি দিয়ে। ঠান্ডা বা গরম পানি দিয়ে স্যালাইন বানানো যাবে না, বানানোর পর ঠান্ডা বা গরমও করা যাবে না।  

৫. বিধি মোতাবেক স্যালাইন না খাওয়া 

কত বছর বয়সে কতটুকু স্যালাইন খাওয়ানো যাবে তা স্যালাইনের প্যাকেটে লেখা থাকে। এছাড়াও আরো কিছু সতর্কতার উল্লেখ থাকে। 

প্যাকেটে বর্ণিত বিধি মেনে স্যালাইন খাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ।