মহাবিচার দিবসে মহামহিম আল্লাহ অনুযোগ করবেন, …
‘হে আদমসন্তান! আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম। তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে খাবার দাও নি।’
অভিযুক্ত তখন আরজ করবে, ‘হে মহান অন্নদাতা! তুমি যেখানে সবার অন্নের ব্যবস্থা করো, সেখানে আমি তোমাকে কীভাবে খাওয়াব?’
আল্লাহ বলবেন, ‘অমুক তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে খাবার দাও নি। তুমি কি জানতে না যে, তখন যদি তুমি তাকে খাবার দিতে, তাহলে তার পুরস্কার আমার কাছ থেকে পেতে?’
আর্তের সেবা যে কত বড় মাপের পূণ্যের কাজ বা সাদাকা তা আমরা এই হাদীসটি থেকে অনুধাবন করতে পারি।
মুসলিম শরীফের আরেকটি হাদীস হচ্ছে- "সাদাকা বা দান বা অন্যের সেবা হচ্ছে ঈমানের প্রমাণ"
কাজেই আপনি প্রকৃত বিশ্বাসী কিনা তার প্রকাশ ঘটবে আপনি যথাসম্ভব অন্যের সেবা করেন কিনা, অপরের কল্যাণার্থে ব্যয় তথা দান করেন কিনা তার মধ্য দিয়ে।
সবচেয়ে বড় পাঁচ হাদীসবেত্তার একজন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস। একবার মসজিদে নববীতে এতেকাফ করছিলেন। এর মধ্যে এক ব্যক্তি এসে জানালো, কয়েকজনের কাছ থেকে সে ঋণ করেছে, কিন্তু তা শোধ করতে পারছে না। ঋণদাতাদের চাপে অসহায় দিন গুজার করছে সে।
ইবনে আব্বাস ঠিক করলেন ঋণদাতার সাথে কথা বলে ঋণ পরিশোধের জন্যে লোকটিকে আরো কিছুদিন সময় দিতে অনুরোধ করবেন। তাৎক্ষণিক মসজিদ থেকে বেরিয়ে পড়ছিলেন তিনি। এ-দেখে লোকটি বিস্মিত হলো।
“হুজুর, আপনি যে এতেকাফে ছিলেন তা কি ভুলে গেছেন?”
জবাবে ইবনে আব্বাস বললেন, “না, ভুলি নি! তবে আমি নবীজীকে (স) বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজনে, অর্থাৎ দুস্থের দুর্গতি লাঘবে কোথাও যাবে, তার জন্যে এই কাজটা হবে ১০ বছরের এতেকাফের চেয়ে উত্তম।“
দুস্থের দুর্গতি লাঘবের প্রয়াস ১০ বছরের এতেকাফের চেয়ে উত্তম! (ছবিসূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক)
বঞ্চিতের প্রয়োজন পূরণ করা এতেকাফের চেয়ে বেশি সওয়াবেরই শুধু না, কখনো কখনো হজ না করেও হজ কবুলের সমান সওয়াব পাওয়া যেতে পারে এ-কাজের মাধ্যমে।
খুব বড় বুজুর্গ ছিলেন জুন্নুন মিসরি। ইলমে মারেফাতের একজন কাণ্ডারি ছিলেন তিনি।
একবার হজ শেষ করে আরাফাতের ময়দানে ধ্যানে ডুবে গেলেন। ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই তিনি জানতে পারলেন যে, সে-বছর মাত্র একজনের হজ কবুল হয়েছে! কিন্তু তার উসিলায় সব হাজির হজ কবুল হয়ে গেছে। অথচ তিনি সেবার হজেই আসেন নি! নাম তার আহম্মেদ আশফাক। পেশায় মুচি, থাকেন দামেস্কে।
জুন্নুস মিসরির খুব কৌতূহল হলো। হজ শেষে চলে গেলেন দামেস্কে। খুঁজে বের করলেন মুচি আহম্মেদ আশফাককে। সহজ-সরল, একদম সাদামাটা একজন মানুষ। এমন কোনো বিশেষত্ব তার মধ্যে নেই যেজন্যে সে আল্লাহর কাছ থেকে এত বড় পুরস্কার পেতে পারে। কিন্তু আসল ঘটনা জানার পর বুজুর্গ হলেন বিস্মিত-বিমুগ্ধ।
হজে যেতে ৪০ বছর ধরে সঞ্চয় করছিলেন আহম্মেদ আশফাক (ছবিসূত্র- ehsantravels.com)
যৎসামান্য আয় হতো সেখান থেকে ৪০ বছর ধরে অল্প অল্প করে বাঁচিয়ে রাখছিলেন হজে যাওয়ার রাহাখরচ জোগাতে। হজে যাবেন, সব ঠিকঠাক; তখনই একদিন একটি ঘটনা সব কিছু ওলটপালট করে দিল।
যেদিন মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন সেদিন সকালে আশফাকের ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এসে জানাল যে অমুক প্রতিবেশীর বাড়িতে মাংস রান্নার গন্ধ পেয়ে সে মাংস খেতে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবেশী তাকে না দিয়ে চলে যেতে বলেছে।
শুনে আশফাক একটু উত্তেজিত হলেন। ছোট্ট শিশুকে খাবার না দিয়ে উল্টো তাড়িয়ে দিল! এ কেমন কার্পন্য! কিন্তু ঘটনার পেছনের ঘটনা জেনে তিনি শোকে দুঃখে মর্মাহত হলেন।
দুই/তিন দিন ধরে ঘরে কোনো খাবার ছিল না। নিরুপায় হয়ে ফেলে রাখা একটি মৃত গাধার শরীর থেকে মাংস কেটে রান্নার জন্যে চূলায় বসিয়েছিল। তখনই আসে আশফাকের ছোট্ট ছেলেটা। নিজেরা অনাহারে থেকে গাধার মাংস খাচ্ছে নিরুপায় হয়ে। কিন্তু জেনেবুঝে আরেকজনকে কী করে সেই মাংস খাওয়ায়!
প্রতিবেশীর মুখে কথাগুলো শুনে আশফাক দুঃখে-অনুতাপে-সমবেদনায় হতবাক হয়ে গেল। দৌড়ে গেল বাড়িতে; এক ঝটকায় তুলে নিল ৪০ বছরের সঞ্চিত টাকার থলি। তুলে দিল প্রতিবেশীর হাতে ক্ষুধা মিটিয়ে বাকিটা দিয়ে কিছু করে খেতে।
দানের বদৌলতে হজে না গিয়েও কবুল হজের সওয়াব পেলেন মুচি আহম্মেদ আশফাক! (ছবিসূত্র- Wikimedia Commons)
জুন্নুন মিসরি আশফাকের মুখে সবটা জেনে বুঝলেন অভাবী-বঞ্চিত প্রতিবেশীকে দান করার মধ্যে দিয়ে এত বড় একটি কাজ সে করেছে যার বদৌলতে আল্লাহ হজে না যাওয়া সত্ত্বেও তাকে দিয়েছেন কবুল হজের সওয়াব। আর তার উসিলায় কবুল করে নিয়েছেন অন্য সকল হাজীর হজ!
মহামতি বুদ্ধ, শ্রী কৃষ্ণ, শ্রী রাম, হযরত ইব্রাহিম, ঈসা (আ), মুসা (আ), নবীজী (স)- যুগে যুগে কালে কালে যত ধর্মীয় পুরুষ এসেছেন তাদের সবার ঐ এক শিক্ষা- মানুষের কল্যাণ করতে হবে!
তারা ঘরে বসে নীরবে জিকির করার চেয়ে, ওজিফা পড়ার চেয়ে মানুষের কল্যাণ করাটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ মহাবিচার দিবসে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন না যে, এই ওজিফা এতবার পড়েছ কি না, এই সুরা এতবার পড়েছ কি না; বরং জিজ্ঞেস করবেন ক্ষুধার্তকে অন্ন দিয়েছ কিনা, তৃষ্ণার্তকে পানি দিয়েছ কিনা।
মহাবিচার দিবসে আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন ক্ষুধার্তকে অন্ন দিয়েছ কিনা! (ছবিসূত্র- dreamstime.com)
মহামানবেরা এটা তারা জানতেন এবং ব্যাক্তিজীবনে চর্চার মাধ্যমে তার দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রেখে গেছেন।
ইমাম সাহেবের ছিল এক খ্রিষ্টান প্রতিবেশী। লোকটি পেশায় ছিল মুচি। প্রায় রাতেই সে মদ খেয়ে ঘরে ফিরে বউকে পেটাত। তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে মহল্লার লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে বসরার গভর্নরের কাছে বিচার দিল। গভর্নর পুলিশ পাঠিয়ে লোকটাকে ধরে নিয়ে গেল।
সেই রাতে ইমাম সাহেব আর কোনো চিল্লাচিল্লির আওয়াজ শুনলেন।
পরদিন ভোরবেলা ফজরের নামাজের জন্যে তিনি মসজিদের দিকে রওনা দিয়েছেন। মুচির বাসা অতিক্রম করার সময় ভেতর থেকে মহিলার কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলেন। খুব করুণ স্বরে কান্না বিলাপ করে কান্না।
তিনি থামলেন। বাইরে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন যে, মা! কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?
মুচির বউ কাঁদতে কাঁদতে বলল, হুজুর! আমার স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। ঘরে খাবার নেই; বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে না খেয়ে আছি!
ইমাম সাহেব মসজিদের দিকে না গিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। স্ত্রীকে বললেন নাশতা তৈরি করে জলদি মুচির বাসায় খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। এরপর তিনি আবার মসজিদে রওনা দিলেন নামাজ পড়ার জন্যে।
সামর্থ্যানুযায়ী আর্তের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করা যে একজন বিশ্বাসীর জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (ছবিসূত্র- Adobe Stock)
এত বড় ইমাম, ইসলামের চার মাযহাবের এক যার নামে। যাচ্ছিলেন নামাজ পড়তে মসজিদে। যখন দেখলেন বিপন্ন ক্ষুধার্ত মানুষ, তাগিদ বোধ করেছেন তার কষ্ট নিবারণের। সামর্থ্যানুযায়ী আর্তের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করা যে একজন বিশ্বাসীর জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা অনুধাবন করতে পারি।
আরো পড়ুন-