সিনিয়র ক্লাসে উঠলে প্রথমেই চিরুনি হারিয়ে ফেলতে হবে—এটাই নিয়ম! কপাল যদি দেখা যায় তো সাড়ে-সর্বনাশ, চোখও দেখা না গেলে ভালো! আর যার প্যান্ট যত কোমরের কাছে থাকবে সে তত মফিজ। অতএব দ্যাটস আ বিগ নো। হাঁটতে হবে আছড়ে-পাছড়ে, কথা বলবে আধাসিদ্ধ ইংরেজি আর খ্যাত বাংলার বীভৎস মিশ্রণে, “ঘর” হবে “গহ্ড়”- “যাচ্ছি” হবে “যাস্সি” - তাহলেই না তুমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র।
ক্লাসে আসা ইজ ইয়োর পাস্টাইম ওনলি। বাপ এত কষ্টের কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালবে, কষ্ট করে ক্লাসে আসতে হবে, আবার কষ্ট করে পড়াশুনাও করবে? মামাবাড়িতেও তো এত আবদার কেউ কোনদিন করে নাই! আরে, তুমি পড়াশুনা করলে ফ্রেন্ডদের সমস্যাগুলো সমাধান করবেটা কে শুনি? আর বুক যদি খুলতেই হয় তাহলে ফেইসবুক তো আছেই। টেক্সটবুক অনেক আউটডেটেড হয়ে গেছে, ওতে ‘লাইক’ করার কিছু আছে নাকি? ফ্রেন্ডরা তো সারারাত ফেইসবুকেই থাকে, এমনকী ‘কুল’ স্যার আর ‘জোস্’ ম্যাডামরাও। তাদের সাথে কানেক্টেড না থাকলে কি হয়?
পড়াশুনা আনন্দের সাথে করতে হবে না? ক্লাস যদি একটু ফ্রেন্ডলি আর হোমলি না হয়, একটু যদি আড্ডা দিতে না পারি, টিচারকে জ্বালিয়ে বার-বি-কিউ যদি না করতে পারি তাহলে আনন্দটা থাকল কই? এই বয়সটাই তো হল কেমিস্ট্রি মিস্ কে ‘চেক আউট’ করার, বায়ো মিস্ কে প্যাম্পার করার আর সদ্য বেরোনো ‘প্রাপ্ত-বয়স্ক’ ডিভিডিটা চালাচালি করার। এই বয়সে জীবনের রঙ-রস-রূপ হারিয়ে ফেললে বিবেকের কাছে কী জবাব দেবে?
একবার এক স্টুডেন্ট চাকু নিয়ে তার সহপাঠীকে আক্রমণ করল। এই ঘটনা নতুন নয়, তার হিংস্র স্বভাবের পরিচয় আগেও পাওয়া গেছে। সে নিজেকে বিশাল গ্যাংস্টার মনে করে। প্রতিবারই তার প্যারেন্টসকে ডাকা হয় এবং প্রতিবারই তার প্রবল প্রভাবশালী উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা বাবা এসে আদরের দুলালকে ডিফেন্ড করে স্কুলকে তাকে মানুষ করতে না পারার গ্লানি দিয়ে চলে যান। তাকে বোঝানোই যায় না যে, মানুষ করার দায়িত্ব ঘরেরই বেশি।
আর একদিন এক মেয়ে ক্লাসে এসে কাঁদছিল। সে জানালো সকালে তার মাকে বাবা ছুরি নিয়ে মারতে গিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে কী করব? মুখে হয়তো বলছি “আমরা তোমার পাশে আছি; আমরা নিজেরাই তো এত বড় একটা ফ্যামিলি। বাসায় যতবড় সমস্যাই থাক এখানে তুমি সেফ.. ..” – কিন্তু মনে মনে কি বুঝি না যে এই কথা কেবল শুনতেই ভালো, এর পেছনে কোনো শক্ত ভিত্তি নেই? কারণ আমার পক্ষে এই মেয়েটা বা এই ছেলেটাকে সারাক্ষণ দেখে রাখা সম্ভব নয়। এরা যদি কখনও ইয়াবায় আসক্ত হয়, বয়স হওয়ার আগেই শরীরী ভোগবিলাসে অভ্যস্ত হয় তখন কী বলব—দোষটা কাদের? ছেলেমেয়েগুলো বদমাইশ, নাকি তাদের বাবা মায়েরা কেবল জন্ম দিয়েই দায়িত্ব শেষ—এই আনন্দে মাতোয়ারা বলেই এমন হচ্ছে?
তবে হ্যাঁ, কেবল বাবা-মার বেলেল্লাপনাই যে সবক্ষেত্রে দায়ী তা নয়। একটা ঘটনা বলি—একবার এক মা আসলেন ছেলে কমার্স সাবজেক্টে খারাপ করেছে কেন সেটা জানতে। ছেলে তাকে বুঝিয়েছে তার কোচিং লাগবে। আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম দেখেন ক্লাসে যা পড়ানো হয়, সেটা যদি পড়ে তাহলে অনায়াসে ফুল মার্কস পাওয়া যায়। তো আপনি যদি প্রতিদিনের পড়া বাসায় ধরেন তাহলেই হয়ে যায়। তিনি তখন বেশ অসহায় হয়েই বললেন, ছেলে এমনিতেই কথা শুনে না আবার পড়া নিতে গেলে বলে তোমরা বাংলা পড়ালেখা করা মানুষ এগুলার কিছুই বুঝবা না!–এইরকম অতিরিক্ত স্মার্ট সন্তানের হাতে কাবু হওয়া বাবা মায়ের সংখ্যাও কম নয়।
সেদিন এক ক্লাস সেভেনের স্টুডেন্ট, আটটায় স্কুল শুরু, এসেছে দশটায়। বকা দিলাম। সে কাঁদতে কাঁদতে জানালো গত রাতে লেট নাইট পার্টিতে গিয়েছিল প্যারেন্টসের সাথে। কেমন দায়িত্বহীন প্যারেন্টস যে বাচ্চাকে শনিবার রাত পর্যন্ত পার্টিতে নিয়ে যায়? কল করলাম দুই জনকেই। অবাক হলাম যখন দেখলাম দুই নয়, চারজন এসে পড়েছেন। বুঝলাম। বললাম বায়োলজিকাল প্যারেন্টস ছাড়া বাকি দুই জনকে বাইরে যেতে। বাচ্চাটার জন্যে মায়া হলো। এরকম ব্রোকেন ফ্যামিলির সন্তান এখানে অনেক।
টিচার্স রুমে ঢুকেই এক স্যার বললেন, ‘এইগুলা কোনো মানুষের বাচ্চা হতে পারে না। জানোয়ার সব। কোন ম্যানার জানে না। স্কুল যেন তাদের বাপের সম্পত্তি। টিচারকে যে ন্যূনতম সম্মান করতে হয় সেই জ্ঞানটাও নেই।’– অথচ এই স্যারই কিন্তু স্টুডেন্টদের ‘জানোয়ার’ ছাড়া বেশি কিছু ভাবতে পারছেন না; মা-বাপ তুলে তার পরিবারের অভদ্রতাকে শাপান্ত করছেন; তখন কিন্তু তার ‘ন্যূনতম সম্মান’ বোধের কথা মাথায় থাকে না! এরমধ্যে আবার উল্টোচিত্রও আছে: ছাত্রছাত্রীদের খুশি রাখতে গিয়েও ‘ন্যূনতম সম্মান’ বিসর্জন দেন অনেকে। যার পেছনে কারণটা হলো ব্যবসায়িক স্বার্থ। দুই শিক্ষকের একটা কথোপকথন তুলে ধরি—
আমি এই স্কুলের স্টুডেন্ট ছিলাম যখন, তখন ইংলিশ মিডিয়ামে আসত হাতে গোনা কিছু পরিবার থেকে। এখন তো যার একেবারেই সামর্থ্য নেই তারা ছাড়া সবাই-ই এখানে আসছে। যাদের এখানকার কালচারটা সম্পর্কে হয়ত কোনো পূর্বজ্ঞান ছিল না। ফলে তারা এই লোকাল এনভায়রনমেন্ট-ফরেন কারিকুলামে পড়ে একটা কালচারাল ডিলেমাতে ভুগছে। এই যে শিক্ষার মাধ্যমটা ইংলিশ—এটাকে বোঝার জন্যে একটা স্টুডেন্ট নিজেকে সেই লেভেলের ম্যাচ্যুরিটিতে নিজেকে নিয়ে যেতে চায় যেখানে ইংল্যান্ডে বসে তার সমবয়সী একজন সাবলীলভাবে রচনা লিখছে ‘লাইফ অফ এ প্রস্টিট্যুট’। যেটা হয়ত আমাদের কালচারে ঠিক যায় না।
সে ঘরে দেখছে তার মাকে-একজন ডিসেন্ট মহিলা বা বড় বোন হয়ত কিচেনে তেজপাতায় জীবনের বিদ্যাশিক্ষা করছে। আবার স্কুলে বা কোচিংএ বন্ধুদেরকে দেখছে এক একজন টিভি শো ‘ফ্রেন্ডস’ এর এক একটা চরিত্র যারা ষোল বছর বয়সেই কৌমার্য না-ধরে রাখা বিরাট প্রেস্টিজ ইস্যু মনে করে। বাবা হয়তো নামাজ পড়ছে, সে দেখছে ‘হাও আই মেট ইয়োর মাদার’। অথবা বাস্তব বলে ধরে নিচ্ছে এমটিভি’র ‘রোডিস্’–এর চিত্রটাকে, যেখানে একটা মোটরসাইকেল পাওয়ার জন্যে একটা মেয়ে একটা ছেলেকে তার শরীর দেখাচ্ছে! সে শেকড়টাকে অগ্রাহ্যও করতে পারে না আবার ‘নো স্ট্রিংস এটাচড্’ রিলেশনের এন্টারটেইনমেন্টও ছাড়তে পারে না। সে না হয় ঘরকা, না ঘটকা।
আসুন এবার গার্ডিয়ানের কথায়। আজকে একটা প্যারেন্টস-টিচার মিটিং হলো। এখানে কয়জন প্যারেন্টস এসেছেন আর যারাই এসেছেন,কয়জনকে মনে হয়েছে আসলেই ছেলেমেয়ের পড়ালেখার বাপারে কেয়ার করে? দেখুন, আমার মা ছিলেন সিমপ্লি বাংলায় আর্টস থেকে বিএ পাস। তিনি যে ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি বুঝেন না এটা বুঝতেই আমার ভার্সিটি পার হয়ে গেছে। স্কুল বা কোচিং থেকে বাসায় গেছি। প্রথমেই ব্যাগ খুলে বলতেন কি পড়া হয়েছে আজ বের কর। আজ তো বাবা মারা জানেনই না তার সন্তান কোন্ ক্লাসে পড়ে বা কি পড়ে, কোথায় যায়!
তারা সন্তানকে সময় দেন না, দেন কাড়ি কাড়ি টাকা। এখন স্টুডেন্টদের ফালতু আড্ডা দেবার জায়গার অভাব নেই। আমাদের বাবা মা বন্ধুদের নিয়ে বাইরে খাবার কথা বললেই বলতেন বাসায় নিয়ে আয় এখানে লাঞ্চ করে যাবে। তাও সবসময় না, বার্থ ডে বা অন্য কোনো উপলক্ষে। বন্ধুরাও জিজ্ঞেস করত তোর বাসায় যাব, আন্টি মাইন্ড করবেন না তো? আর আজ বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে তোর পকেটে কত টাকা আছে, কেএফসিতে খাওয়া। অর্থাৎ ছেলেমেয়েরা এখন এতটা স্বাধীন, কোনো দায়িত্বও নেই, এত টাকা তাদের, নষ্ট হবার এত সুযোগ, সাথে বাবা মায়ের অবহেলা—পড়ালেখায় তারা মন দেবে কেন? কোন দুঃখে?
একবার এক ছাত্রী এসেছে চুল হাইলাইট করে যেটা ছাত্রীসুলভ ছিল না মোটেই। গার্ডিয়ান ডাকলাম, জুতার বাড়িটা আমার উপরেই পড়ল! বেটিকা মা তো আরও কয়েক ডিগ্রি উপরে! তাকে দেখে আমাদের কালচারের তো মনে হলোই না, কোন দেশি সেটাও বোঝা গেল না। তিনি নিজেই পরিচয় ভুলে আত্মহারা হয়ে আছেন, মেয়েকে কি শেখাবেন? উনি নিজে পুরা কাপড়-চোপড় না পরে যদি মেয়েকে মিনি-স্কার্ট পরতে বাধা দেন–কাজ হবে কী?
মাছ যখন পচে, মাথা থেকেই পচে। ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যে শিক্ষকই বেশি দায়ী। কিছু পরিবর্তন করতে হলে প্রথমেই এই মাথা ঠিক করতে হবে। শিক্ষকরা এটাকে দেখেন একটা ইন্ডাস্ট্রি হিসাবে। সেবার মনোবৃত্তি যেখানে কম, শিক্ষা যেখানে পণ্য। এক এক জন “মীযান” হয়ে গেছি আমরা। মীযান নামের এক হেরোইন ব্যবসায়ীকে চিনি। লম্বা দাড়ি, বিরাট সূফী। সে বেচার আগে বলবে, এটা খেলে তো তুমি মারা যাবা। তাই আমি এটা তোমাকে দিতে চাই না। কিন্তু আমি তোমার কষ্ট দেখে থাকতে পারি না। তাই বেচলাম। এই মীযান তাকে নূরের আলোও দেখায় আবার মৃত্যুকূপেও ঠেলে দেয়। এখানে আমরা যে যার মত লুটে নিচ্ছি। ছাত্রকে এক্সপ্লয়েট করছি, পঙ্গু করে দিচ্ছি, অন্তঃসারশূন্য করে দিচ্ছি, কিন্তু ভাব করছি ঠিক তার উলটা।
" শিক্ষককে এমন হতে হবে যেন স্টুডেন্ট তাকে দেখে তার মত হতে চায়। তার মনে হবে এডুকেটেড হওয়াটাই জীবনের সব। কিন্তু আমরা শিক্ষকরা এখন তা-ই যা আমাদের স্টুডেন্টরা। আমরা কোচিং এ ‘হু দ্য *** আর ইউ?’ টি শার্ট পরে দেখাতে চাই আমি কত ওপেন, লিবারেল; আমার কাছে আসো। স্টুডেন্টরাও বলছে, স্যা-র-র্, আপনি অ-ন্নে-ক কুল। আমরাও খুশিতে গদগদ! স্টুডেন্টরা শিখবে কি? "
আমাদের বদলাতে হবে। কিন্তু আমি একা বদলালে তো হবে না। আমি এই স্কুলে ভর্তি হয়েছি কয়েক বছর হলো। ‘ভর্তি হয়েছি’ বললাম কারন আমার শিক্ষা এখনো পূর্ণ হয় নি। এখানে এসে আমার উচ্চশিক্ষা হচ্ছে। পজেটিভ সেন্সেই বলছি। অনেক কিছু দেখছি, বুঝছি, কিছু করতে চেষ্টাও করেছি কিন্তু আসলে বড় কিছু করতে হলে একা হয় না। আপনি খুব ভদ্র, নম্র, নীতিবান শিক্ষক হয়ে ক্লাসে যান আজকে, কাল থেকে আপনি হয়ে যাবেন মদন, আনস্মার্ট। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি ন্যুনতম শিষ্টাচার, নীতিবোধ, মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়া যেত তাহলে এগুলো চমৎকার বিদ্যাপীঠে পরিণত হত। শিক্ষকদের হতে হবে ভদ্রলোক; তারা ভালো কিছু উৎসাহিত করবেন, খারাপের জন্যে গঠনমূলক শাস্তিও দিবেন। তারা ছাত্রদের মধ্যে বিদ্যা গ্রহনের মনোবৃত্তিটা গড়ে তুলবেন। তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে বা নোট দিয়ে অন্তঃসারশূন্য, পঙ্গু, অমানুষ করে তুলবেন না। কিন্তু তা আর পারছি কই? কেউ কি জানেন কীভাবে পারা যাবে?