চিকিৎসাবিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতা—এদের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়

শিক্ষাবিদ, লেখক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের খ্যাতিমান অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের সাবেক ডীন। সুস্বাস্থ্য, মেডিটেশন, সুস্থ জীবনাচার ও সঠিক খাদ্যাভ্যাস বিষয়ে নিয়মিত লিখছেন কোয়ান্টাম ওয়েবসাইটে।

 

স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা নিরূপণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য ছিল—স্বাস্থ্য মানে আপনি কেবল নীরোগ আর অটুট স্বাস্থ্যের অধিকারী, তা-ই নয়। আপনি শারীরিক মানসিক আর সামাজিকভাবে কুশলে আছেন কিনা তা-ও আসে স্বাস্থ্যের সংজ্ঞার মধ্যে। তবে পরবর্তীতে এই সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে নতুন একটি দিক—আধ্যাত্মিক কুশল। আর এর গুরুত্ব যে ক্রমে ক্রমে বাড়ছে, তা সবার নজরে আসছে।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সব অসুখের নিদান কি পেয়েছি আমরা? আমরা অনেক সময় বা জীবনের অন্তিম প্রান্তে এসে বিজ্ঞানের সব অস্ত্র প্রয়োগ করার পর সন্ধান করি একটি শান্তিময় মৃত্যু। আর সেই দিক সামলাবে কে? বিজ্ঞান সেই দুয়ারে পৌঁছতে পারে নি।

প্রশান্তির জন্য কী চায় তখন মন?

আধ্যত্মিকতা তখন পাশে এসে দাঁড়াতে পারে।

নৈতিকতার দ্বারা সমাজ পরিচালিত হবে তা-ই কথা ছিল, কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। সামাজিক দুর্বলতা বাড়ছে। আর তাই বাড়ছে আত্মহত্যা ও গার্হস্থ্য হিংসা। আধ্যাত্মিকতা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি মেলবন্ধন করা গেলে এমন সব সমস্যার কিছুটা নিষ্পত্তি হতে পারে।

এই যে মানসিক চাপ, এর ফলে ঘটছে নানান দুষ্কর্ম। একে তাড়ানোর একটি উপায় হতে পারে আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ। আর আধ্যত্মিকতা মানুষকে সভ্যতার মূলে ফেরায়। এ কেবল ধর্মাচরণ নয়, সার্বিকভাবে আত্ম-অনুসন্ধান।

তবে আধ্যত্মিকতা নিয়ে অনেক মনীষী প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে বহু গবেষণালব্ধ বার্তা দিলেও এর পূর্ণায়ত রূপ সমাজে প্রতিফলিত হলো না। যদিও পারিপার্শ্বিক জীবনের ক্ষুদ্রতা হীনতা রিরংসা ত্যাগ করে সবাইকে নিয়ে সুখের ভুবনে সামাজিক কুশলে বাস করার ইতিবাচক পরামর্শ দেয় আধ্যাত্মিকতা।

‘নিজেকে জানাটাই আধ্যাত্মিকতা। আত্মাকে অধিকার করে যা আছে তা-ই তো আধ্যাত্মিকতা।’—প্রখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলছিলেন এক আলাপচারিতায়। আর তিনি আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে এসেছিলেন এই আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে। আধ্যাত্মিকতা মঙ্গলবার্তা শোনায়, মনে আনে শান্তি আনন্দ স্বস্তি যা সার্বিক কুশলের জন্য বড় প্রয়োজনীয়।

একটা কথা বলি—মনের কি আকার আছে? আছে কি কোনো অবয়ব? তবে কেন মনে জমে মেঘ?

এই যন্ত্র আর প্রযুক্তি, আর আসছে এআই, এতে মনের দুয়ারে ঘা আরো বেশি করে পড়বে, কোনোকিছুতে মনোনিবেশ করার দক্ষতা অনেক কমবে। এর সাথে আসবে মানসিক উদ্বেগ অবসন্নতা দুশ্চিন্তা। আর যন্ত্র বয়ে নিয়ে আসবে জীবন-যন্ত্রণা। যন্ত্র যখন সব কাজ করে দেবে, তাহলে নিজের করার রইল কী? এই একাকীত্ব আর বিষণ্ণতা কি আচ্ছন্ন করবে না মনকে?

মনকে তাই শান্ত করতে প্রসারিত করতে হবে অন্তর্দৃষ্টি । নিজের যত্ন নিতে আমরা ভুলেছি, সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ছে, আর তাই জীবনে বাড়ছে জটিলতা। এ অবস্থায় নিজেই নিজের বন্ধু হওয়া কম জরুরি নয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর যা-ই করুক, আধ্যাত্মবাদ সৃষ্টি করতে পারবে না। এর জন্য দরকার হবে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা। নৈতিকতা আর মূল্যবোধের অবক্ষয় যখন দ্বারপ্রান্তে, এই আধ্যাত্মিক কুশলের বার্তা এবং এর চর্চা কিছুটা হলেও সার্বিক কুশলের পথ দেখাতে পারে।