বহুত্বের দেশ, বহুত্বের পৃথিবী

শিক্ষাবিদ, লেখক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার।

 

বহুত্ব-ভাবনার পটভূমি

‘গো-হারা’ ‘গো-হারান’ কথাটি কলকাতার বাংলা সাংবাদিকতায় বিহারের নির্বাচন প্রসঙ্গে একটি প্রিয় শব্দ হয়ে উঠেছিল। বিস্ময়ের কথা এই যে, কোনো বাংলা অভিধানে এ শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে আমরা যারা ভাষা নিয়ে কাজকর্ম করি, আমাদের কাছে টেলিফোন আসে, কথাটা এলো কোত্থেকে। কোন যুদ্ধে গোরুরা হেরে গিয়েছিল, কারা ছিল তাদের প্রতিপক্ষ? যদি মানুষ তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে থাকে তো বাঘসিংহই জিততে পারে না, গোরু তো কোন ছার। মানুষের হাতে শুধু ছুরি-চাপাতি নেই, আছে পিস্তল, রাইফেল স্টেনগান থেকে নানা পারমাণবিক হাইড্রোজেন বোমা জাতীয় অস্ত্র, কাজেই পৃথিবীতে মানুষের সঙ্গে যুদ্ধে সব প্রাণী আর উদ্ভিদ হেরে বসে আছে সেই কবে থেকেই। তা হলে কথাটা শুধু নিরীহ গোরুদের ওপর চাপানো হলো কেন? আমাদের মধ্যে একদল ঈর্ষাযোগ্য সম্প্রদায়, যারা সেই দুর্লভ প্রজাতির মানুষ, যাদের পূর্বপুরুষ জমিদার বা সাহেব সিভিলিয়ান ছিলেন, তাদের বাড়িতে এখনো সেই সব ঝাপসা হওয়া বাঁধানো সাদা-কালো ফটোগ্রাফ নিশ্চয়ই আছে, যাতে কোনো এক ব্যক্তি বুক ফুলিয়ে এক হাতে রাইফেল ধরে এক পা একটি মৃত বাঘ বা হরিণের ওপর চাপিয়ে ফটো তুলছেন। সেই সব সুখের দিন আর নেই, জমিদার আর শিকারি সাহেবেরাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমার স্ত্রীর মুখে শোনা ঢাকাই প্রবাদে বলা যায় ‘হেই সব দিন বাঘে খাইয়া ফালাইসে’।

তবু পৃথিবীতে প্রাণী, গাছপালা আর জড়প্রকৃতির ওপর আমরা মানুষরা এমন প্রভু হয়ে বসেছি, সব নির্বিকারে ধ্বংস করে পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছি আমরা, আখেরে তা যে আমাদেরই ধ্বংস ডেকে আনছে সে সম্বন্ধে আমাদের কোনো খেয়ালই নেই। আমাদের সন্তানদের জন্য কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি, তা নিয়ে কে ভাবে? শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, বৃহৎ শিল্পের জন্য, নগরায়ন করে রাস্তাঘাট এয়ারপোর্ট বহুতল তৈরির জন্য—সবই কেটেকুটে একসা করে দিচ্ছি আমরা। মানুষের কাছে সবাই তো হেরে বসে আছে, তা হলে শুধু গোরু বেচারিদের আলাদা করে বেছে নেয়া কেন?

মুশকিল হলো, একদল মানুষ তো শুধু পশুপাখি অরণ্য-পাহাড়-নদী-সমুদ্রকে হারিয়ে সুখী থাকে না, তারা মানুষকেও হারাতে চায়। তারা ভাবে, পৃথিবীতে বা দেশে শুধু আমরাই থাকব, অন্যেরা হয় আমাদের মধ্যে থাকবে না, অন্য দেশে চলে যাবে, না হয় আমাদের পায়ের তলায় থাকবে, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে, আমাদের ইচ্ছের চাকর হয়ে, আমাদের হুকুমমতো সব করবে তারা। আমরা উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। তারা কেউ অন্য ধর্মের, কেউ একই ধর্মের মধ্যে অন্য সংঘের, কেউ অন্য গায়ের রঙের, কেউ অন্য ভাষার—কিংবা এর দুটো-তিনটে-চারটে এক সঙ্গে মিলিয়ে। আমরা, একরঙারাই রাজা হয়ে থাকব, যাদের রঙ আলাদা তারা থাকবে প্রজা বা দাস হয়ে। জয় এক রঙের জয়!

জানি না, আগে মুনিঋষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতার লড়াইয়ে একের গোরুর পাল অন্যেরা নিয়ে যেতেন, বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের লড়াইয়ের মতো, তার মধ্যে ‘গো-হারান’ কথাটার সূত্র আছে কি না। শিষ্যেরা হাততালি দিয়ে বলত কি না, ‘দুয়ো, দুয়ো, গো-জেতা সম্ভব হলো না, গো-হারানই জুটল কপালে!’ কিন্তু এই কাল্পনিক অন্বেষণ থাক।

বহুত্বের বিস্তার

সেদিন একটি অসহিষ্ণুতাবিরোধী জমায়েতে এই নিয়ে দু-চার কথা বলার পর মঞ্চ থেকে নেমেছি, একটি যুবক আমাকে ধরল। খুব দুঃখের সঙ্গে বলল, ‘আপনি তো ভালো ভালো কথা বললেন। কিন্তু দেখুন তো, নেপাল ছিল পৃথিবীতে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র, তাও ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে গেল। আমাদের আর কী রইল তা হলে?’

মনে হয় কলেজেরই ছাত্র ছেলেটি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, নেপালে মানুষ রইল তো? যে-মানুষ অত্যাচারী রাজাদের তাড়িয়েছে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন চালু করেছে? রাষ্ট্রের পরিচয় হিন্দু হোক না-হোক, তাতে কী এসে যায়? বরং ধর্মনিরপেক্ষ হলেই তো সকলের সমান সুযোগ আসবে।’

ছেলেটি তাতে সান্ত্বনা পেল বলে মনে হয় না।

এরা জানে না বা বুঝতে পারে না যে, একরাঙা দেশ মানে শ্রেষ্ঠ দেশ নয়। সবচেয়ে শক্তিধর দেশ নয়। এমন দেশ নয় যে, যেখানে সব অভাব দূর হয়ে গেছে, সব মানুষ সুখে আছে, ধনে, জ্ঞানে, স্বাস্থ্যে, শিক্ষায়, গৌরবে পৃথিবীতে শীর্ষ স্থান লাভ করেছে। কিন্তু এ থেকেই মনে প্রশ্নগুলি এলো, কত ধরনের বহুত্ব আছে পৃথিবীতে? কী কারণে আছে? সব বহুত্বই কি ভালো বা কাম্য? বহুত্ব সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত।

যেখানে বহুত্ব একটা প্রাকৃতিক ঘটনা

উপরেই আমরা ছুঁয়ে এসেছি, মানুষের জগতে শুধু বহুত্ব নেই, প্রকৃতির জগতেও আছে। দু-ক্ষেত্রেই এই বহুত্ব বা বৈচিত্র্য বহুলাংশে প্রাকৃতিক, কিয়দংশে অবশ্যই সাংস্কৃতিক, অর্থাৎ মূলত মানুষের সৃষ্টি। অবশ্যই এর দ্বারা এটা বলা হচ্ছে না যে, শুধু মানুষেরই সংস্কৃতি আছে, অন্য প্রাণীর নেই। তবে ভাষার সহায়তায় মানুষের সংস্কৃতির যে বিপুল বিস্তার ও সমৃদ্ধি ঘটেছে অন্য প্রাণীর ক্ষেত্রে সেটা হয় নি।

যে বৈচিত্র্য বা বহুত্ব প্রদত্ত, প্রাকৃতিক ঘটনা—সেগুলোর মৌলিক হিসেব বৈজ্ঞানিকেরা জানেন, আমাদের সেখানে প্রবেশ নেই। কিন্তু আমরা সাদা চোখে যা দেখি, তাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। জড়জগতে দৃশ্যের বিপুল বৈচিত্র্য, আকাশে, পৃথিবীতে, কোথায় নেই। ভূবিজ্ঞান বা ভূগোলশাস্ত্রীর পরিবেশ-নজর আমাদের নেই, কিন্তু নদী-পাহাড়-সমুদ্র-মরুভূমি-স্তেপ-প্রান্তর, পৃথিবীর উপরে, গর্ভে কত বিচিত্র উপাদান। জানি না মহাকাশ পুরো জরিপ করা সম্ভব হয়েছে কি না, কিন্তু তার কোটি কোটি সংখ্যার প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের ভূমিতে আরো কত অগণিত উপাদান লুকিয়ে আছে কে জানে! মানুষ কোনোদিন সেগুলি উদ্ধার করে ব্যবহার আর ক্ষয় করতে পারবে কি না তাও জানি না। সুখের বিষয় যে, জড়বস্তুদের নিজেদের মধ্যে কোনো ঘোষিত ঝগড়া নেই, আত্মপরের ভেদ নেই, যা একে অন্যের অস্তিত্ব মুছে দেওয়ার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছ, এমন নয়।

অন্ধ প্রাকৃতিক আপতনের ফলে নানা সংঘাত ঘটে। তবু ভূমিকম্প, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুদগার, বন্যা, বরফ-ধস, শিলাপ্রপাত, উল্কাপাত ইত্যাদি সত্ত্বেও পৃথিবী (কোটি) বছর ধরে টিকে আছে। উদ্ভিদ জগতে বিপুল বৈচিত্র্য, যেমন বিচিত্র প্রাণীজগতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর সুইডিশ জীব ও উদ্ভিদবিজ্ঞানী কার্ল ফন লিনিয়াস (১৭০৭-১৭৭৮) সে-সবের বিপুল বর্গীকরণ করেছিলেন, তার সঙ্গে নতুন নতুন বর্গ এখনো জুড়ে যাচ্ছি আমরা। হ্যাঁ, কিছু প্রাণী অন্য প্রাণীকে খেয়ে বেঁচে থাকে, ‘খাদ্য-শৃঙ্খল’ বলে একটা ব্যাপার আছে পৃথিবীতে। তাতেও পৃথিবী খুব একটা টাল খায় নি এতদিনে। কারণ মানুষ ছাড়া পৃথিবীর জীব, উদ্ভিদ আর জড়ের বৈচিত্র্যকে বিপুলভাবে ধ্বংস করার ইচ্ছা আর ক্ষমতা আর কারো নেই। অনেক পাখি আর বাঘ-সিংহ ইত্যাদি সম্বন্ধে ইংরেজিতে predator বা ‘শিকারি প্রাণী’ কথাটা চালু আছে, কিন্তু মানুষের মতো predator জীবজগতে আর একটিও নেই। মানুষ প্রাণী আর উদ্ভিদ উভয়কেই ‘হত্যা’ করে, মূলত এইভাবে—

১. সে পৃথিবীর জড়সম্পদ নানা উপায়ে ধ্বংস আর রূপান্তরিত করে। ভূগর্ভের জল শেষ করে দেয়, খনিজ তেল, কয়লা, নানা ধাতু সব তুলে এনে কাজে লাগায়। জল, তেল, কয়লা—এসব শেষ হয়ে যায়, আবর্তনযোগ্য থাকে না।

২. সে প্রচুর প্রাণী ও উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার জন্য হত্যা করে; উদ্ভিদের শস্য, তা থেকে উৎপাদিত তেল এবং অন্যান্য রূপান্তর (জ্যাম, জেলি, সস্‌) ইত্যাদি সে ভোগ করে।

৩. খাওয়া ছাড়াও নানা শখে বা পার্বণে শিকার করে আনন্দ সংগ্রহ করে। মনে রাখতে হবে, পশুপাখিরা কদাচিৎ খাদ্যের প্রয়োজনে ছাড়া অন্য প্রাণী শিকার করে। একসময় মানুষের প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ডুয়েলে কখনো নরহত্যায় পর্যবসিত, কিন্তু পশুদের ক্ষেত্রে খুব কম ক্ষেত্রেই তা ঘটে।

৪. নানা আসবাব, পোশাক এবং অন্যান্য ব্যবহার্য বস্তুর নির্মাণে সে গাছের শরীর, পাতা আর পশুর হাড়, চামড়া, এবং অন্যান্য শারীরিক জিনিস ব্যবহার করে। তার তালিকা বিশাল।

ফলে পৃথিবীর জড়বস্তু, প্রাণ এবং উদ্ভিদের ‘বহুত্ব’ ধ্বংস করার ব্যাপারে মানুষ যতটা সর্বাঙ্গীণ ভূমিকা নিয়েছে এমন আর কোনো প্রাণী নেয় নি। পরে আমরা দেখব যে, মানুষ অবশ্য নিজের বহুত্বও ধ্বংস করে, কারণ সে নিজেকে ‘হত্যা’ করার নানা উপায় বার করেছে, ব্যক্তিগত জিঘাংসা থেকে রাষ্ট্রগত বা বৈশ্বিক মহাযুদ্ধ পর্যন্ত। সে সম্বন্ধে আমরা পরে বলব।

মনে রাখতে হবে—আগেও আমরা যেমন বলেছি—জীব, উদ্ভিদ এবং জড়জগতের এই বহুত্ব মোটের উপর ক্ষতিকর নয়, তার উপরেই অস্তিত্বের একটা বিশাল ন্যায় আর বৈধতা লক্ষ বছর ধরে তৈরি হয়ে ছিল। যা-কিছু ক্ষতি করেছে মানুষ। সে এই বৈচিত্র্য ধ্বংস আর হ্রাস করার ব্যাপারে প্রধান উদ্যোগী।

যে বহুত্ব মানুষের, অথচ মানুষের সৃষ্টি নয়

তাও মোটামুটি সকলের চোখে পড়ে। প্রথম তো নারী আর পুরুষের ভাগ, যেটা না থাকলে মানবজাতির অস্তিত্ব আর প্রবহমানতা বিপন্ন হয়ে পড়ত। তার সঙ্গে ইদানীং সচেতন হয়ে আমরা তৃতীয় লিঙ্গকে নাগরিক বৈধতা দিয়েছি। তারা মানুষের ঘরেই জন্মায়, কিন্তু নিজেরা সন্তানের জন্মপ্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না। তা ছাড়া মানুষের শারীরিক নানা বৈশিষ্ট্য—যেমন গায়ের রঙ, চুলের রঙ, ঠোঁট, নাক, চোখ ইত্যাদির গড়ন—ইত্যাদি নৃবৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য—যার ভিত্তিতে ‘কালো’, ‘বাদামি’, ‘হলুদ’ ইত্যাদি মানব-প্রজাতিতে মানুষকে ভাগ করা হয়। এদের পরস্পরের মিশ্রণে আবার নতুন উপপ্রজাতি তৈরি হয়। মার্কিন দেশে সাদা আর কালোর বিবাহে যেমন mulatto বা মুলাটো নামে চিহ্নিত হয় কিছু মানুষ। আবার ব্যক্তিগতভাবে এই সব প্রজাতি আর উপপ্রজাতির মধ্যেও দৈর্ঘ্যের, কণ্ঠস্বরের, মেজাজের বহুত্ব থাকে। এই সব দেখেশুনে মনে হয় প্রকৃতির পরিকল্পনাই হচ্ছে ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য বা বহুত্ব নির্মাণ করা—নানাভাবে, নানা লক্ষণে। ভাষা যদিও সাংস্কৃতিক নির্মাণ, তবু তা তৈরিতে ব্যক্তিমানুষের কোনো হাত ছিল না, অন্তত তার বহুত্বে তো ছিলই না—তাই ভাষাকেও আমরা তর্কসাপেক্ষে প্রাকৃতিক বহুত্বের মধ্যেই ফেলতে পারি। কিন্তু ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্রের বৈষম্য, উঁচু জাত, জল-চল জাত, জল-অচল অচ্ছুত জাত—হিন্দু সমাজে এই বৈষম্য নিছক মানুষেরই সৃষ্টি, তার আরো দৃষ্টান্ত আমরা নীচে দেখব।

যে বহুত্ব মানুষের, কিন্তু মানুষের সৃষ্টি

আমরা সবাই জানি যে, নানা ধরনের বহুত্ব মানুষ নিজে তৈরি করেছে। তাতে হয়তো প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে—বেশি বা কম—সাহায্য করেছে। যেমন রাষ্ট্র। এবং রাষ্ট্রনির্ভর জাতীয়তা। যেমন ধর্ম। যেমন পোশাক—যা অনেক সময় ধর্ম, রাষ্ট্র আর জাতীয়তার দ্বারা এবং অবশ্যই প্রাকৃতিক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সংস্কৃতিও একইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এইভাবে গৃহনির্মাণ-স্থাপত্য, খাদ্যাখাদ্য বিচার, পোশাক, শারীরিক পরিচর্যা (চুল কাটা ও রাখা, তার নানা কায়দা, দাড়ি-গোঁফ কাটা ও রাখা), গায়ে উল্কি আঁকানো, আদব-কায়দা ইত্যাদি বহু ব্যাপারে আমরা নানা ধরনের বহুত্ব বা ভিন্নতা গড়ে তুলেছি। আজ-কাল এডোয়ার্ড সাইদের Self আর Other—এই দুটি কথা ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ‘আত্ম’ আর ‘অপর’—দুটি কথাই বহুত্বকে নির্ভুলভাবে নির্দেশ করে। ফলে পৃথিবীতে বহুত্বের মধ্যে সম্পর্কটা এই দাঁড়িয়েছে যে, একদিকে ‘আমি’ বা ‘আমার গোষ্ঠী’ আর এর বাইরে ‘একটি’ নয় আরো ‘বহু’ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। আবার দেখা যাবে যে, যার ভিত্তিতে ‘আমি’ তৈরি হল, ধরা যাক আমার নীল জিন্স পরার ইচ্ছে, দেখা যায় যে তারও একটা দল দাঁড়িয়ে যায়, যদিও এদের মধ্যে দলের সংহতি, এমনকি পরিচয় আর আদান-প্রদান না-ও থাকতে পারে। এই দল নিছক চিহ্নের ভিত্তিতে, পরস্পরের যোগাযোগ আর আদান-প্রদানের ভিত্তিতে নয়।

অবশ্যই কখনো কখনো এক-এক সম্পর্ক হয় না তা নয়। সভ্যতার কোনো একটা স্তরে মানুষ বিবাহপ্রথা আবিষ্কার করায় একটি পুরুষ ও নারী বিবাহসূত্রে মিলিত হয়, একটা মৌলিক বহুত্বের জায়গায় একটা বোঝাপড়া মানুষকে প্রাকৃতিক কারণে করতেই হয়। তৃতীয় লিঙ্গের বিবাহও এখন আইনসিদ্ধ হয়েছে একাধিক দেশে, কিন্তু সেখানে সন্তানের জন্মের বিষয়টি বিবেচ্য নয়, যদিও সন্তান পালন সে বিবাহে নিশ্চয়ই সম্ভব। দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক—অনুকূল বা প্রতিকূল—হতেই পারে। কিন্তু আমরা দেখি যে, ‘আমি’ ব্যক্তিই হই আর গোষ্ঠীই হই, যে প্রাকৃতিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণের দ্বারা আমার/আমাদের আত্মপরিচয় তৈরি হোক না কেন, প্রতিটি ‘আমি/আমরা’ বিপরীতে অসংখ্য ‘ওরা’ দাঁড়িয়ে যায়। আমি বাঙালি, তার বাইরে আছে, ‘না-বাঙালি’ কথাটার আশ্রয়ে, অবাঙালি ভারতীয়রা এবং বিদেশের হাজারো গোষ্ঠী। আমি ‘ইস্ট বেঙ্গল’-এর সমর্থক—এই বোধের বাইরে থেকে গেল অজস্র অপর—মোহনবাগান, মহমেডান, ইস্টার্ন রেল (এখন কী আছে), বেঙ্গালুরু এফ সি, গোয়ার চার্চিল ইত্যাদি বহু ক্লাবের সমর্থক। আমি ভারতীয় ক্রিকেট দল, তো আমার অপর হলো অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ ইত্যাদির ক্রিকেট দল। বহুত্ব থাকলেই একটা ‘আত্ম’-‘অপর’-এর গেরোতে আমাদের পড়তে হবে, নির্ঘাত। ভুল বললাম, অনেক আত্ম, অনেক অপর। নীচে যেমন দেখব।

আবার একটা আত্মপরিচয়ের সঙ্গে আরেকটা পরিচয়ের কাটাকুটি লাগে, তার সংঘাতও হয়। আমার যেহেতু একাধিক ‘আত্ম’ আর একাধিক ‘অপর’—সেহেতু আমার বিরোধের একটা জটিল মানচিত্র তৈরি হয়। আমি বাঙালি এবং আমি মুসলমান। পাকিস্তান পর্বে (১৯৪৭-১৯৭১) বাংলাদেশের বাঙালিদের মধ্যে একটা স্ববিরোধ তৈরি হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব তা থেকে সেখানকার অধিকাংশ বাঙালিকে মুক্তি দিয়েছিল। এই বহু আত্মপরিচয়ের মধ্যে কোনটি আমার কাছে প্রধান হয়ে উঠবে, তার ওপর সমস্ত অপরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্ভর করবে। এর জন্য গোষ্ঠী ভাঙে, রাষ্ট্র ভাঙে; আবার নতুন গোষ্ঠী, নতুন রাষ্ট্র তৈরি হয়। কিছু আত্মপরিচয় অবশ্যই অপরিবর্তনীয় বা প্রায় অপরিবর্তনীয়। যেমন আমি কারো সন্তান বা কেউ আমার সন্তান। কিন্তু তাতেও আত্মপরিচয় প্রায়ই পরিবর্তমান হয়ে ওঠে, তা সময় ইতিহাস আর প্রতিবেশের অধীন। রাজা অয়দিপাউসকে প্রায় বিধ্বংসী দুঃখের অভিঘাতে বুঝতে হয়েছিল এই ভয়ংকর পরিবর্তমানতার কথা। সমাজবিজ্ঞানীদের একটা অংশ এসব নিয়েই নিমগ্ন থাকেন।

কিন্তু পরিবর্তনের অধীন তো বহু পরিচয়। কিছু ইচ্ছাধীন নয়, কিছু ইচ্ছাকৃত। বালক আমি, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ আমি, মৃত আমি। এই সত্তাবান আর পরিবর্তমান, ইচ্ছাধীন আর অনিচ্ছাধীন—আত্মত্ব আর বহুত্বের বিষয়ে আমাদের মনোভাব বা attitude কী, সেটাই আমাদের ব্যক্তিগত আর সামাজিক অস্তিত্বকে অর্থপূর্ণ করে তোলে, আমার সম্বন্ধে অন্যদের মনোভাবকে নির্মাণ করে।

আসল কথা, বহুত্বের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

কাজেই ‘বহুত্ব’ কথাটা একটা দুমুখো অস্ত্র, অনেকটা ‘ঐতিহ্য’ কথাটার মতো। স্লোগানের মতো ‘বহুত্ব’ বা ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে’, এমন উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়। আমরা দেখলাম যে, সব বহুত্ব রক্ষা করার মতো নয়, সব ঐতিহ্যও রক্ষা করার মতো নয়। বহুত্ব এক হিসেবে ‘আত্ম’ আর ‘অপর’—এই বোধের মূলে। কিন্তু আত্ম আর অপরের সম্বন্ধ, মোদ্দাভাবে এই চার রকমের হতে পারে। এর মধ্যে আরো সূক্ষ্ম স্তর-পরম্পরা থাকতেই পারে, এমনকি সময় বিশেষে একটা থেকে আরেকটায় বদলে যেতেও পারে, কিন্তু তার মধ্যে আমরা যাচ্ছি না—

১. অজ্ঞতার অর্থাৎ আমরা জানিই না যে আমাদের বাইরে আর কেউ বা কিছু আছে। তার একটা স্তরে, বা এখনো হয়তো কোনো আদিবাসী অরণ্যগোষ্ঠী এরকম ভাবে।

২. জানার পরে উপেক্ষার

৩. জানার পর সহনশীলতার, এমনকি অভ্যর্থনা ও বন্ধুত্বের

৪. ভয়ের, সন্দেহ আর শত্রুতার, যা থেকে ধ্বংস করার ইচ্ছা তৈরি হয়।

আবার বলি, এসব সম্পর্কই বদলাতে পারে সময়ে আর নানা কার্যকারণে এবং কখনো নানা সম্পর্ক মিশ্রিত রূপেও দেখা দিতে পারে। কারণ আমরা গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করছি এবং গোষ্ঠীটি বহু সদস্যের সমষ্টি। দুই গোষ্ঠীর সব সদস্যের সঙ্গে সব সদস্যের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং প্রতি ব্যক্তির সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর সম্পর্ক কোনো একটি মুহূর্তে যেমন এক নয়, তেমনি তাও পরিবর্তনের অধীন। এর সহজ দৃষ্টান্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সাদা কালো—এই দুই জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক। ইতিহাসে তা গোষ্ঠীগতভাবে বদলেছে। প্রথমে যারা আফ্রিকা থেকে মেরে-কেটে ধরে আনা ক্রীতদাস মাত্র ছিল, যাদের নারীরা সাদাদের ধর্ষণের শিকার, পরে অ্যাব্রাহাম লিঙ্কনের সময়ে আইন করে তাদের ক্রীতদাসত্ব মোচন করা হল। তাদের কেউ কাউ সাদাদের প্রিয়পাত্রও হয়ে উঠল, যেমন শ্রীমতী হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র গল্পের আংক্‌ল টম। কিন্তু সামগ্রিকভাবে যে বেশ কিছু সাদার মধ্যে অবজ্ঞা আর ঘৃণা থেকেই গেছে (আমাদের বাঙালিদেরও আছে কালোদের সম্বন্ধে) তা তো জর্জ ফ্লয়েডের ঘটনা থেকেই বোঝা গেল। কালোদের কাছেও তাই ‘আংক্‌ল টম’ কথাটা এখন একটা ব্যঙ্গের কথা। যে-সব কালো মানুষ সাদাদের ভাষা আর আদব-কায়দা অনুকরণ করে সাদাদের দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে, তাদের ওরা বলে ‘আংকল্‌ টম’।

কোন বহুত্ব আমরা রক্ষা করব?

কাজেই শেষ পর্যন্ত এই সত্যের মুখোমুখি আমাদের হতেই হয় যে, সব বহুত্ব রক্ষণযোগ্য নয়। বহুত্ব সম্বন্ধে আমাদের সব ভাবনা বা মনোভাব রক্ষণীয় নয়। কোন বহুত্ব সম্বন্ধে আমরা সহনশীল হবো, গ্রহিষ্ণু হবো, তাকে রক্ষণীয় মনে করব? প্রকৃতির ক্ষেত্রে পরিবেশবিজ্ঞানীরা আমাদের নির্দেশ দেবেন, প্রাকৃতিক সম্পদের—জড়সম্পদ আর উদ্ভিদ সম্পদের এবং বলা বাহুল্য প্রাণসম্পদের রক্ষণের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতেই হবে। এমন কথা কেউ বলে না যে, আমাদের এসব সম্পদের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কিন্তু নির্বিচার ও খেলাচ্ছলে ধ্বংস করা থেকে যেমন একদিকে নিবৃত্ত হতে হবে, তেমনই ‘রিসাইক্‌লিং’ বা পুনর্ণবায়নের মধ্য দিয়ে সম্পদগুলিকে পুনঃসৃষ্টি করার দায়িত্ব নিতে হবে। বড়লোক পুঁজিবাদী দেশগুলি এই ধ্বংস আর নির্বিচার অপচয়ের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অপরাধী। কিন্তু সেখানেও অন্তত সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা এসেছে। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো কাগজ নতুন জমিতে পাইনের জঙ্গল সৃষ্টি করছে, কাগজের জন্য পাইন গাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে। অবশ্যই কাগজের বৈদ্যুতিক সংস্করণ এসে যাওয়ায় তাতে খানিকটা সুরাহা হয়েছে, কাগজের ব্যবহার এবং তার ফলে গাছের ধ্বংসও কমেছে। প্রায় ৬০ বছর আগেই আমরা দেখেছিলাম যুক্তরাষ্ট্রে gas guzzler বড় গাড়ির তুলনায় ছোট গাড়ির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। গাড়ি থেকে ধোঁয়া বেরোনো নিয়ন্ত্রণের নানা কলকৌশল করা হচ্ছে।

খাদ্যের জন্য জীবধ্বংসের ক্ষেত্রেও এই পুনর্ণবায়ন প্রক্রিয়া বহুদেশেই চালু আছে। সেখানে অন্যান্য কাজের পশু আর খাদ্যের পশু আলাদা করে লালন করা হয়। খনিজ সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রেও বিকল্পের সন্ধান বহুদিন থেকে চলছে। পেট্রল আর ডিজেলের বদলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসচালিত গাড়ি এসে গেছে। নিশ্চয় তাতে জৈব জ্বালানির ব্যবহার কমবে এবং বায়ুদূষণও কমবে। জল সংরক্ষণের জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যদিও ভারতে আমরা তেমন সচেতনতার লক্ষণ দেখি না।

আসল কথা মানুষের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের রক্ষা। প্রাকৃতিক বহুত্বের মধ্যে তৃতীয় লিঙ্গ এবং নানাভাবে ব্যাহত-শক্তি মানুষেরাও পরে, তা আমরা আগে বলেছি। ব্যাহত-শক্তি কথাটা এখন বদলে দিয়ে ‘সুভাষণ’ বা euphemism প্রয়োগ করে বলা হয় otherwise abled ‘ভিন্নশক্তিধর’ তা আমরা লক্ষ করেছি। অর্থাৎ জীবন পেয়েছে যে, তার পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে--এই মানবিক অধিকারের স্বীকৃতি আদায় করা গেছে, যদিও সব রাষ্ট্র সমানভাবে এই স্বীকৃতিকে মান্য করে না। নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা আমরা সর্বত্র এখনো স্বীকার করে উঠতে পারি নি, তৃতীয় লিঙ্গ আর ভিন্নশক্তিধরদের অধিকারও। আর সাদা, কালো, হলুদ, বাদামি গায়ের রঙ বা নাক-মুখ চুলের চেহারা, আমাদের হিন্দু সমাজের মধ্যেই ব্রহ্মণ্যবাদীদের রোজগারের সুবিধার জন্য তৈরি ঘৃণ্য জাতিভেদ, ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক ভেদ, আদিবাসী-অনাদিবাসী ভেদ অনুযায়ী মানুষের বহুত্বকে আমরা ‘অপর’-ত্বের চিহ্ন ভেবে নিয়ে অবজ্ঞা বা ঘৃণা করব, এই বোধকে আমাদের বিসর্জন দিতে হবে। দরিদ্র, নিরক্ষর, ভারতে তথাকথিত ‘হীন’ জীবিকার মানুষ আমাদের কাছে যেন ‘অপর’ না হয়ে ওঠে। মনুষ্যত্বের মূল সম্পদে সকলেই সম্পদবান—নৃবিজ্ঞানের এই দৃষ্টি যেন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। সেখানে বহুত্ব মানে অপরত্ব নয়, অবজ্ঞেয় বা ঘৃণার্হ নয়। বরং যারা উপেক্ষিত এবং পশ্চাৎপদ, যে ক্ষুধার্ত, যে শিক্ষাবঞ্চিত, চিকিৎসাবঞ্চিত, আর্ত ও অসহায়, তাদের জন্য ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সহানুভূতি আর সাহায্য নিয়ে যেন আমরা সবসময় প্রস্তুত থাকি। এই বহুত্বগুলি অবাঞ্ছিত, এগুলি মানুষের বিকাশের সহায়ক নয়, বিনাশের সহায়ক। এই সব সর্বনাশা বহুত্বের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই।

রাষ্ট্র একটি সাংস্কৃতিক নির্মাণ, জাতীয়তাও একটি সাংস্কৃতিক ধারণা। কিন্তু এগুলি উপরের মানবিক অধিকারের মতো চিরকালের জন্য রক্ষণীয় কিছু নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ। প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্র ভেঙে গ্রিস দেশ তৈরি হওয়া, প্রাচীন বহু সাম্রাজ্য ভেঙে নতুন দেশের জন্ম থেকে বাংলাদেশের জন্ম, সোভিয়ত রুশের ভাঙন, চেকোস্লোভাকিয়ার বিলুপ্তি ইত্যাদি তারই প্রমাণ দেয়। তবে রাষ্ট্রিক সাম্রাজ্যবাদের অবলুপ্তি ঘটেছে—এটা ইতিহাসের একটা ইতিবাচক বিবর্তন। অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ অবশ্য ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে, জানি না তা তৃতীয় কোনো বিশ্বযুদ্ধ এনে পৃথিবীর মানচিত্র আবার বদলে দেবে কি না। সেই অপরিমেয় ধ্বংস যাতে আর না ঘটে তার জন্য আমাদের সমস্ত প্রতিরোধের অস্ত্র শাণিত রাখতে হবে।